সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৭

শীতকালীন গল্প বৈঠক - ৩

ভাষা কথা বলে, লেখক নয়। এমনটাই মনে হচ্ছিল ২৭ জানুয়ারি গল্পবৈঠকের গল্পপাঠ শুনতে শুনতে। এবারের নবম গল্পবৈঠক বসেছিল কলকাতা বইমেলায় কারিগরের স্টলে। কারিগর এবং গল্প বৈঠকের যৌথ আয়োজন ছিল সেদিন। প্রকাশনার জগতে কারিগর একটি শৈল্পিক নাম। দৃষ্টিনন্দন স্টলে, দেওয়াল জোড়া বই বৈঠকের সঠিক আবহ রচনা করেছিল, সঙ্গে ছিল কারিগরের কর্ণধার দেবাশিস সাউ দম্পতির আন্তরিক আতিথ্য এবং বৈঠকের কাণ্ডারী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ার বৈঠা বাওয়া ।

 পাঠে ছিলেন  চোদ্দ জন গল্পকার,  যাঁরা কেউ নিজের একটি ভাষা খুঁজে পেয়েছেন,  কেউ বা এখনো সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে পঠিত প্রতিটি গল্পই শরীরে  ধরতে চেয়েছে সময়ের চিহ্ন ।  কস্তুরী চট্ট্যোপাধ্যায়ের 'অসমাপ্ত' গল্পে বাবার ইচ্ছের হাত ধরেছিল দেবী। সোনালীর গল্প 'ও জিসাস' ধর্ম আর কামনাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দেখায়। সুষ্মেলী দত্তের 'রোদ' প্রকৃতির রূপকে নারী পুরুষের বৈষম্যকে তুলে ধরে । শাশ্বতী সরকারের 'বিষাদের ঘরবাড়ি'-র শ্রীর আর্তনাদ না উল্লাস বোঝা যায় না। ভাস্বতী ব্যানার্জির 'ডুবোপাহাড়' ইঙ্গিত দেয় আসন্ন বিস্ফোরণের । কৃষ্ণা রায় তাঁর 'বিষাদযাত্রা'য় মৃত ফোয়ারার সামনে বসে জলের জন্য এক অন্তহীন প্রতীক্ষার আশ্চর্য ছবি আঁকেন।সীমিত শব্দে বুবুন চট্ট্যোপাধ্যায়ের 'ফেসবুক ফ্রেন্ড' গল্পে ভার্চুয়াল জগতের ছুঁতে না পারার যন্ত্রণা বুকে মুচড়ে ওঠে । মহুয়া মল্লিকের 'ফুল ফুটুক না ফুটুক ' শ্রোতাকে ধাক্কা মেরে ফেলে ডার্ক ফ্যান্টাসির রহস্যঘন জগতে । এর ঠিক বিপ্রতীপে চৈতালি চট্যোপাধ্যায়ের 'কান্না আর না ' যেখানে ফিল-গুড আবহে বিপন্ন শৈশব খুঁজে পায় উষ্ণ আশ্রয়। দিন আর রাতের পৃথিবীর রূপ যে কত আলাদা তার প্রায় পরাবাস্তব আখ্যান গার্গী রায়চৌধুরীর 'রোষ'। সেখান থেকে রূঢ় বাস্তবে আছড়ে ফেলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় তাঁর 'পাগলী' গল্পে। সিলভিনা ওকাম্পোর স্প্যানিশ গল্পের স্বকৃত বাংলা তর্জমা ' কাঁচে লেপ্টে থাকা মুন্ডু ' পাঠ করে আবারো মুগ্ধ করলেন অনুবাদক  জয়া চৌধুরী । তৃষ্ণা বসাকের 'আনবাটনড' অক্ষয়কুমারকে কেন্দ্র করে এই সময়কে বোতাম খুলে দেখায় আর পরিশেষে যশোধরা রায়চৌধুরীর 'সিরিয়াল ' গল্পের চাপা সন্ত্রাস আমাদের আচমকা শ্বাসরোধ করে । জীবন বেশি লম্বা না সিরিয়াল?

এর মধ্যেই হৈহৈ করে শ্রীযুক্ত পবিত্র সরকারের হাতে উদ্বোধন হল গার্গী রায়চৌধুরীর সংগ্রহযোগ্য গল্পগ্রন্থ যার প্রকাশক কারিগর । বিশেষ অতিথি কবি, গল্পকারএবং নাট্য নির্দেশক আশিস গিরির গল্পপাঠ এবং সুপরিচিত সঞ্চালক রিনির বক্তব্য এই মনোরম বিকেলের উপরি পাওনা ।

সমগ্র অনুষ্ঠানটি চমৎকার  সঞ্চালনা করলেন সুদর্শনা সঞ্চারী চক্রবর্তী । শুরুতে ছিল তাঁর গান। আর চৈতালিদির গান সেদিন যে শুনতে পেল না সে যে কী হারাল,  ভাগ্যিস জানে না !

তবে এরপরও কথা থাকে । গল্পপাঠের শেষে টাটকা আলোচনা হলে গল্পবৈঠকের উদ্দেশ্য সার্থকতর হত।
তৃষ্ণা বসাক   

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৭

শীতকালীন গল্প বৈঠক (২)


২১ জানুয়ারি র উদাসীন চাতাল। স্থানঃ রবীন্দ্র সরোবর, লেকের মাঠ। 

সেদিন দুপুরে, না বারবেলা নয়, লেবু চা আর ঝালমুড়ি র গন্ধে জাফরি কাটা রোদ ছিল।আর সেই রোদের ভেতরে ছিলাম আমরা। আমাদের বন্ধুরা। ২১ শে জানুয়ারি দুপুর ১ টা। আমরা যারা লেখালেখি করি, অনেক পারা, না-পারা সরিয়ে লিখতে চাই, লেখা শুনতে চাই সেই গল্প বৈঠকের বন্ধু রা জড়ো হয়েছিলাম শীতের মিঠে রোদ্দুর ডানায় নিয়ে। লেকের মাঠে, এক উদাসীন চাতালে। সেই চাতালে সঞ্চারী চক্রবর্তী র গান দিয়ে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান।


 


এদিনের অনুষ্ঠানে প্রথমেই গল্প পড়লেন গার্গী রায়চৌধুরী। খুব বেশিদিন নয়, কিন্তু এরই মধ্যে গার্গী র লেখায় স্বাতন্ত্র্য বলে ভবিষ্যতে আর ও ভাল গল্প দেবেন পাঠক কে গার্গী। "ঘাতক" গল্পে গার্গী তুলে ধরেছে একধরনের ফ্রয়েডীয় অবচেতন। পরের গল্পকার অধম। বিচ্ছেদকাতর দম্পতি র সন্তান ছোট্ট মেয়ে টুপুর যে তার বাবা-মা র থেকে ডিভোর্স চায়। কিন্তু পায় কি? তাই আমার গল্পের নাম ছিল। " যদি হত!" পরবর্তী গল্পকার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। সোশ্যাল মিডিয়া কোন জাদুতে সব বদলে দিচ্ছে এক একটি পরিবার তার ই টুকরো টুকরো আভাষ দিলেন ইন্দিরা তাঁর "কৌরব পক্ষ বদলে পান্ডব পক্ষ"গল্পে। ইন্দিরা র কলমের রসবোধ পাঠক অনেকদিন মনে রাখবেন।

এবারের গল্পকার ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়। উদীয়মান চিত্র পরিচালক অনিন্দ্য র সামনে কিভাবে বদলে গেল মেয়েটার দৃষ্টি তাই শোনালেন ভাস্বতী তাঁর " তিলোত্তমা " গল্পে। ভাস্বতী র গল্পে অনেক ধুসর রঙের পরত থাকে সিরিয়াস পাঠকের জন্য!
পাঠক! মাঝখানে চা-মুড়ি- নলেন গুড়ের সন্দেশের নরম সরম কিন্তু চলছেই।
এর ই মধ্যে পায়ে পায়ে হাজির হয়েছেন কোলকাতার মেয়র পারিষদ দম্পতি।



 দেবাশিষ কুমার এবং দেবযানী কুমার। যাবতীয় পারিষদীয় ঝঞ্ঝাট সামলেও ওরাঁ দুজনে এমন মনোরম শ্রুতিনাটক ( নাটকের নামঃ কলকাতার কপালকুণ্ডলা, রচনা বনানী মুখোপাধ্যায় )  করেন কে জানত! এসেছিলেন গল্পবৈঠকের আমন্ত্রনে। আমাদের আর ও একটু উজ্জীবিত করতে। এসেছিলেন গল্প শোনার লোভে সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও। পাঠশেষে খুব জরুরি কিছু টিপস দিলেন সঙ্গীতা। মনে রাখব সঙ্গীতা।


এবার এলেন রজত দা। মানে আমাদের রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর "বদলে গেল হজমল" এ পেলাম আবারো সেই অনায়াস উইট। সঞ্জীব চাটুজ্যের উত্তরাধিকার তাঁর কলমে বললে অত্যুক্তি হবে না।
এদিনের গল্প পাঠের বিষয় ছিল বদল। সমাজ-সংসার-মননে সেই বদলে যাওয়া র ছবি নানান দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছিলেন গল্পকার রা। তেমন ই কৃষ্ণা রায় তাঁর "রাহাজানি" গল্পে বললেন, দুই প্রৌঢ় -র অর্ধেক স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রনার কথা। মন ভার হয়ে উঠল। তারপরেই দীপান্বিতা রায়ের " অর্কিডের টব" পাঠক মন অবশেষে মেদুর হল প্রিয়তোষের মন বদলে। "জুঁইফুল ১৫" গল্পে সাহিত্যিক কণা বসু মিশ্র র কলমের সেই চিরাচরিত যাদু আবার ফিরে পেলেন পাঠক। পরিচিত গল্পকার মহুয়া মল্লিক এদিন আমাদের শোনালেন তাঁর "শামুক" গল্পে প্রিয়তোষের মেটামরফসিস এর কথা।


পাঠক অধৈর্য হবেন না। বদল। এমন একটি বিষয় ভাবনা নিয়ে এক গুচ্ছ গল্পকার সেদিন সত্যিই রামধনুর পরতে পরতে ছুঁয়ে থাকা কত রঙ যে আবিষ্কার করলেন। আসলে সেদিন শীতের জাফরি কাটা রোদের প্রতিটি খোপে খোপে বসে ছিলেন এক-একজন স্ফুলিঙ্গ। তার ই আভাষ দিচ্ছিলেন তাঁরা। একে একে। যেমন - কস্তুরী চট্টোপাধ্যায় কি দৃপ্ত ভঙ্গিতে শোনালেন তাঁর "দ্বিতীয় বাস" গল্পে মধ্যরাতে চারুর একা একা পথ হাঁটার কথা। তেমন ই সাবলীল গদ্যে পুর্বা মুখোপাধ্যায় বললেন, তাঁর " কথায় কথায় বদল" গল্পে দাম্পত্যের মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের কথা। পাশাপাশি শর্মিষ্ঠা ঘোষ বুনে দিলেন অন্য ভাবনা। সেই বোকা মেয়েটির মাথায় হাত রাখতে চেয়েছিল তানিয়া তাঁর "অপত্য" গল্পে। শাশ্বতী সরকার বললেন তাঁর স্বাদু গদ্যে "একলা পথিক" অনন্ত উত্তরণের পথে বদলে যাওয়ার গল্প। সোনালি পেশায় চিকিৎসক বলেই বোধহয় মানুষ কে দেখেন জীবনের নানা মাত্রিক দিয়ে। তাঁর গল্পেও পেলাম সেই স্বাদ। পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝেও ছিল এক " অন্য জগৎ"। এবার এলেন সদাহাস্যময়ী নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত। নিবেদিতার গল্পের শরীরে আশ্চর্য এক বুনন থাকে। আবার ও প্রমাণ করল" বাসাংসি জির্নানি"।


অতুনু প্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিত গল্পকার। তিনি কী মমতায় শোনালেন সুন্দরবনের এক গ্রামের ছেলের বদলে যাওয়ার গল্প " কানাই-চরিত"। টুপাই এর বদলে যাওয়ার গল্প কে অন্য আঙ্গিকে বদলে দিলেন অয়ন চৌধুরী "দুই বদল " গল্পে। এবার এলেন অনুবাদক জয়া চৌধুরী। শোনালেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্পের অনুবাদ "দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ডুবন্ত মানুষ"।জয়া র অনুবাদে সবসময় ই এক সহজাত দেশীয়করণের গন্ধ থাকে। যা পাঠক কে আটকে রাখে তাঁর অনুবাদে। এদিনের গল্প পাঠের অনুষ্ঠানের শেষ স্ফুলিঙ্গ ছিলেন তৃষ্ণা বসাক। " তেলেনাপোতা " গল্পে তিনি শোনালেন ইয়াকুব মামাদের হারিয়ে যাওয়ার কথা। তৃষ্ণার গল্পে সেই স্যাটায়ার আর ও একবার পাঠক কে ভাবতে বসাল।
শীতের রোদে পিঠ ঠেকিয়ে সেদিন সেই চাতালে এমন দাউ দাউ আগুনের কিন্তু সলতে পাকিয়ে যাচ্ছিলেন পৃত্থীশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সহৃদয় উদ্যোগ এবং শিল্পী নিলয় বিশ্বাস এর গল্প বৈঠক এর চমৎকার ব্যানার ছাড়া থোড়ি আগুন জ্বলত!

সবশেষে আরো একবার বলি সেই সঞ্চালক, ফোটোগ্রাফার, সোশ্যালমিডিয়া এক্সপার্টের কথা তিনি হলেন আমাদের বন্ধু অয়ন চৌধুরী। যাঁর একটান অনর্গল সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং একটুও ছন্দপতন না ঘটিয়ে অনুষ্ঠানের হাল ধরে রাখা সত্যি প্রশংসার দাবী রাখে।  

প্রতিবেদনঃ বুবুন চট্টোপাধ্যায়