বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

গল্পবৈঠক ২৩, সেপ্টেম্বর সোনাটা



বালিগঞ্জের নন্দী স্ট্রীটের ক্যাফে স্ট্রিংসে হয়ে গেল গল্পবৈঠকের ২৩ তম পর্ব। গত ১৬ই সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানের নাম ছিল সেপ্টেম্বর সোনাটা। কিন্তু থাকিয়া গেল রেশ। শেষ  হইয়াও হইল না শেষ। গল্পবৈঠকের অভিধানে 'শেষ' শব্দটি অবান্তর তার আভাস পাওয়া গেল প্রধান উদ্যোক্তা ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের ২৪তম গল্প বৈঠকের সানন্দ আগাম ঘোষণায়। সেপ্টেম্বরের ছুটির বিকেলে
ক্যাফের আনাচকানাচ ভরপুর ছিল সেদিনের নিমগ্ন শ্রোতায় ।
 

সেদিন সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটির ভাবনায়,পরিকল্পনায় এবং সঞ্চালনায় ছিলেন কবি, বাচিক শিল্পী মৌমিতা ঘোষ। শারদ অর্ঘ্য দিয়ে সূচনা হল গল্প বৈঠকের।নবীন প্রবীণ কবিদের শরতের কবিতার ফাঁকে ফাঁকে আগমনী গান গাইলেন তপশ্রী পাল। কিবোর্ড অনুষঙ্গে ছিলেন নীলাদ্রি। বাজল তোমার আলোর বেণু ঝংকৃত হল সঞ্চালিকার প্রাসঙ্গিক কবিতা-ছড়ার কোমল সংযোজনায়। শব্দ-যোজনায় তপোদা।
এবার গল্পপাঠের শুরু। ওইদিন থিম অণুগল্পের বিষয় ছিল দুটি, ঝগড়া অথবা হাসি। ৩০০ শব্দের মধ্যে প্রত্যেকে হাসি অথবা ঝগড়া বিষয়ে গল্প লিখে এনেছিলেন। মূল পর্বে লটারিতে প্রথমেই এলেন সাঁইথিয়ার সুজাতা রায়। অত্যন্ত সাবলীলতায় দোলপূর্ণিমা নিশি'   গল্প আমাদের নিয়ে গেল লক্ষ্মীর পাঁচালীর অন্তর্নিহিত কুপ্রথা-বিরোধিতার আঙিনায়। বেশ সুচারু ভঙ্গিতে পাঁচালীকারের দাঁড়িতে টান মেরেছে সুজাতা। কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়ের মজার 'নাইটি কাহিনী'র ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজল গল্প বৈঠকের বারান্দা। 


বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে আবারো দেখি 'গরু'র দুধে চোনা ফেলে সগর্বে বেরিয়ে গেল ছোট্ট শালিখ। সাদামাটা ঘরোয়া কাহিনী অনবদ্য হয়ে উঠল তাঁর লেখায়। 
স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জেরাতে মোর' গল্পটিতে বিবদমান এক স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সেতু হল দুঃসময়। সোনালীর গল্প 'আধুনিক ভজনের কেচ্ছা' বেশ উপভোগ্য। কেচ্ছাকাহিনীতে কুতূহলী নই কোন বাঙালিবাচ্চা বুক ঠুকে বলবে বাপু? ঘুমন্ত ভজন-বাবুরা জেগে উঠলে ক্যামেরা চলুক বুঝেশুনে। ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'থিম বিভ্রাট' কিন্তু আমাদের চেতনাকে কিঞ্চিৎ ঝাঁকিয়ে  দেয়। এ যেন তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি। থিম-ভরপুর পুজোমণ্ডপে কখনও যদি একচালার ঠাকুর ফিরে আসে তবে জেনারেশন এক্স তা গ্রহণ করবে তো? বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জামবাটি' ও কখনও সখনও প্রান্তিক চাষী দম্পতির আপাত বচসার অন্তরালে নিরুচ্চার প্রেমের ইঙ্গিতবাহী হতে পারে বোঝা গেল। বেশ সুন্দর তাঁর গল্পের বয়ান।
'কালচার' গল্পটিতে রায়গঞ্জের শর্মিষ্ঠা ঘোষ দেখালেন মিঃ কমলাকান্ত বিশ্বাস একাধারে সংস্কৃতি-অপ-সংস্কৃতির মিশেলে একটি বর্ণময় চরিত্র বিশেষ। এরকম চরিত্র খোঁজ করলে দু'একটি মিলেও যায় আমাদের আশে-পাশে। কৃষ্ণা দাসের 'ঠেলার মাল'এ অফিসটাইমের বাদুড় ঝোলা বাসের নৈমিত্তিক একঘেয়েমি থেকে যাত্রীরা খানিক রৌদ্ররসের আভাস নিয়ে গন্তব্যে যায়। উপরি পাওনা।
জয়তী অধিকারীর 'পোষ্য' যখন দু'কেজির ইলিশ দিয়ে ভুরিভোজ সারে তখন মনিবনীর সাথে আমরাও খেপে উঠি। এ কী কাণ্ড! ইলিশ কি সস্তা?
অংশুপ্রতিম দে-র 'যুযুধান' এ আশার কথা শেষমেষ দু'পক্ষের আপোসমিলন। ঝগড়ার মধ্যেও হাসির আভাস। যদিও সাদামাটা গল্পের বিষয়টি তবুও স্বল্প পরিসরে মন কাড়ে।
নন্দিনী সেনগুপ্তর গল্প 'রুপুদের সংসার'-এ পাঠক এতটাই মুগ্ধ যে মনে হয় ওই সংসারের একজন সদস্য হতে পারলে অন্তত রুপুর মায়ের হাতের অরোরা খাওয়া যেত,বাবার ডার্লিং-এর গায়ে পড়ে নানান মস্করা করা যেত।
রজত শুভ্র ব্যানার্জির 'রাধাগোবিন্দবাবুর অভ্যাস' গল্পগুজব শেষে বাড়ি ফিরে দুটি চমচম খাওয়া। আমরা জানিনা কোনো বিশেষ মহিলার হস্তনির্মিত স্মৃতিবিজড়িত কিনা সেই চমচম। তবে তাঁর গল্পে এই অভ্যেস কথাটি যেন বড্ড চেনা মনে হল। যেন অগ্রবর্তিনী কোনও লেখিকার ছায়া দেখতে পাওয়া গেল।
'নৃপতিবাবুর নবীন জীবন'-এ তো নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত বিপত্নীক নৃপতিবাবুকে বেঘোরে স্প্যানিশ দৌড়বীর পুত্রবধূর দৌড়োনোর পোষাক পরিধান করাইয়াই ছাড়িয়াছে । তাহাকে যে দৌড় করায় নাই ইহাতেই পাঠককুলের স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়িয়াছে। টয়লেট পেপারের বাংলা প্রতিশব্দ 'হাগজ' লেখিকার অন্যতম স্বকীয়তার পরিচয় দেয় যা ব্যবহারে তাঁর কলমের দৌরাত্মে তিনি কুণ্ঠিত হন নাই ।
জয়া চৌধুরির 'শিশুপাঠ' এ শিশুর কাছে এখনও অনেক পাঠ নেবার আছে। বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের চাপান উতোর তা দেখাল। তবে গল্পের বুনটে আরেকটু মুনশিয়ানা দেখাতেই পারতেন তিনি।
কৃষ্ণা রায়ের 'গিলোটোলজিস্ট' গল্পে এক জবরদস্ত হাসির খোরাকের রসদ মজুত। একশ'দশ কেজি ওজনের পচাঁত্তর বছর বয়সী মহিলার উপস্থিতিই হাঁ হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। শ্যামলী আচার্যর গল্প 'কাঠি' রাজনীতির কলকাঠির ভাঁটায় সাক্ষাৎ জিয়নকাঠি।পরিশীলিত উপস্থাপনা।
বাংলার অধ্যাপক ঊর্মি দাসের 'লোহিত আকাশ পথে' মর্তের হিরোইন ফ্যাশন ডিজাইনার হিরো ভিলেন প্রভৃতিতে মজেছে স্বর্গের তথাকথিত দেবদেবীরা। স্বর্গের অপ্সরাতে তাদের এখন অরুচি। তবে গল্পটি নির্দিষ্ট শব্দ সীমা অতিক্রম করেছিল তা বলাই বাহুল্য। তমালী রায়ের 'ভুলো'র নায়ক এমনিতে ভালো মানুষ কিন্তু ভুলো। সায়া নামক মেয়েদের অন্তর্বাসে ছেলেদের পাজামা ভ্রম বা চানাচূরের সাথে দহি কম্বিনেশন বেশ অরুচিকর শোনায়। আর তাঁর এহেন শব্দচয়ন গল্পটিতে কোথাও যেন একটু তাল কেটে দেয়।
দীপা চ্যাটার্জি গল্প লেখেন না কিন্তু তাঁর মামীর খোঁপা মামায় বাঁধে সত্যি যেন গল্প ঘটে ছিল একটা পুরুলিয়ার ঘাটে। বেশ। এমন মামা সত্যিই দুর্লভ ।


ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের 'হামি' সাম্প্রতিক সময়োপচিত বিষয় নিয়ে। যা এক নিষ্কলুষ 'হামি' স্মরণ করায়। মধ্যবয়সী নন্দবাবু প্রেম-পিরিতি সন্দর্শনে বেজায় ক্ষুব্ধ। তার স্ত্রী যুগপন্থী। দুটি পায়রার চঞ্চুমিলন রুখতে যে বন্দুক তাক করতে পারে তাকে স্মরণ করাতে হয় তার নিজের যৌবনকালের অনেক মজা-মস্করার স্মৃতিকথা। পক্ষিপ্রেমের সরলতা তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বোঝাতে হয়। প্রকৃত প্রেম নিকষিত হেমস্বরূপ।
গল্প পাঠের শেষপাতে
টপ করে পড়ল তপশ্রী পালের 'নাড়ুর নাক'। পর্যাপ্ত হাস্যরস থাকলেও সকলের হজম হয় নি। কারও কারও অতৃপ্তির ঢেঁকুর উঠেছে গল্প শুনতে শুনতে। কারণ নাক থেকে নিঃসারিত বর্জ্য পদার্থের উপস্থিতি এবং তার সঙ্গে আমাদের সবার অতি প্রিয় নকুলদানার তুলনা।  
ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি রামপ্রসাদী গানের আবেশে মুগ্ধ করলেন সভা। শ্রাবণী ব্যানার্জি শোনালেন দুটি অনবদ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত।
আর অনুষ্ঠান কানায় কানায় পূর্ণ হল মৌমিতাও জয়জিতের মজার অনু শ্রুতিনাটকে। আগাগোড়াই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন মৌমিতা ঘোষ।
আমাদের সকলের প্রিয় লেখিকা কণা বসু মিশ্রর মুখনিঃসৃত কিছু জরুরী কথায় আমরা সমৃদ্ধ হলাম। আশাতীত এবং অতিরিক্ত প্রাপ্তি ছিল সেদিন সিনথেসাইজার বাদক নীলাদ্রির কণ্ঠে আধুনিক বাংলা গান। যে গান সবাইকে চেয়ারচ্যুত করে প্রায় নৃত্যোন্মুখ করে ছেড়েছিল সব শেষে।
ক্যাফের এক কাপ করে চা আর শ্রদ্ধেয়া অগ্রজ সাহিত্যিক কণাদির আনা একটি পরমরোচক মিষ্টি দিয়ে ২৩ তম গল্প বৈঠকের সুখসমাপ্তি হল।




প্রতিবেদনটি লিখেছেন স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়
ফোটো সৌজন্যে, জয়তী ভট্টাচার্য অধিকারী                        
অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র ডিজাইনে নন্দিনী সেনগুপ্ত