সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

'গল্পবৈঠক' ৩৩ @ চন্দননগর





১৪ ই সেপ্টেম্বর, শনিবার "গল্পবৈঠক ৩৩" অনুষ্ঠিত হল শতাব্দ-প্রাচীন হুগলী জেলার চন্দননগর বঙ্গ বিদ্যালয়ে। 
চুঁচুড়া-চন্দননগরের বিশিষ্ট দশজন গল্পকার ও তিনজন অলোচককে "গল্পবৈঠকের" পক্ষ থেকে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। 

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ স্কুলটির একতলার এক শ্রেণীকক্ষে, বাঁশবেড়িয়ার প্রখ্যাত গল্পকার নব বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র ভিত্তিক গল্প 'কোন এক হরেনকে নিয়ে' পাঠের মধ্য দিয়ে আড্ডার সূচনা হয়। লেখক এক্ষেত্রে হরেন ও সুখেন দুটি চরিত্র পাশাপাশি রেখে গল্পটি নির্মাণ করেছেন। গল্পটি নিয়ে আলোচক তার আলোচনায় বলেন, স্মার্ট গল্প। তবে গল্পে সুখেনের ইচ্ছার অপমৃত্যু ঘটেছে।

দ্বিতীয় গল্প 'পাঁচ নম্বর গোধূলি' পাঠ করলেন চুঁচুড়ার গল্পকার সিক্তা গোস্বামী। গার্হস্থ্য জীবনের অণু পরিবারের গল্প, যেখানে মা-বাবার বয়স হলে তাঁরা ব্রাত্য হয়ে যান সংসারে। তাদের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। শেষে অনিচ্ছা সত্বেও ছেলে তার মাকে জোর করে নিয়ে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে, এই ছবি এঁকে লেখিকা পাঠকের কাছে প্রতিটি মা প্রতিটা ছেলের সামনে একটা আয়না তুলে ধরেছেন। আলোচক, গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অশোক ও ঝর্ণার জীবনের ক্রাইসিসের শেষে ট্রাজেডিতে পরিণত হবার কথা বলেছেন। 

এরপর, চুঁচুড়ার প্রখ্যাত গল্পকার বিমল গঙ্গোপাধ্যায় গল্প পাঠ করেন। 'ছায়াসূর্য' নামের এই গল্পটিতে বাবা থেকে রাক্ষস, রাক্ষস থেকে মনুষ্যত্বে নেমে আসার এক ছবি এঁকেছেন। মায়ের আত্মহত্যা, বাবার নোটবই, তাতে ছায়ার খোঁজ, সবই স্বাভাবিক ছন্দে, অন্তরঙ্গ ধারায় বয়ে গেছে গল্পের গতির সাথে। কাহিনীর শেষে মৃত মায়ের ছায়া আর বাবার ছায়ার দূরত্ব কত তা নিরূপণের দায়িত্ব গল্পকার পাঠকের হাতে অর্পণ করে এক দার্শনিক পরিসমাপ্তি ঘটান। আলোচক তাঁর আলোচনায়, গল্পটির ভরবিন্দুর কথা, গল্পটি যে ট্র্যাজেডির তুঙ্গে পাঠকদের নিয়ে চলে গেছিল তা উল্লেখ করেন।

গল্পবৈঠকের নিয়ম অনুযায়ী প্রথম তিনটি গল্প পাঠের শেষে সেই গল্প তিনটি নিয়ে আলোচক মানস সরকার আলোচনা করেন।

চতুর্থ গল্প 'পাগলী'। গল্পকার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের স্বকন্ঠে শোনার অভিজ্ঞতা শ্রোতারা বহুদিন মনে রাখবেন সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। 'অষ্টুমী' নামের পাগলী চরিত্রটি আপাতদৃষ্টিতে নিজেই নিজের দ্বারা লাঞ্ছিত একটি চরিত্র। শ্রোতারা গল্পটিতে লক্ষ্য করেছেন, চরিত্র সৃষ্টিতে লেখিকার সহানুভূতি, নারীর প্রতিবাদ, পুরুষের অনুভূতিহীনতার প্রতি লেখিকার ধিক্কার। আলোচক,  তাঁর আলোচনায় গল্পটিকে একটি বাস্তবের ছবির গল্প রূপে চিহ্ণিত করেন। তিনি গল্পের ভিতরের গল্পটিকে দেখিয়ে দেন তাঁর আলোচনায়। 

চুঁচুড়ার গল্পকার সুব্রত বসু  শোনালেন আসরের পঞ্চম গল্পটি- 'তবু অনন্ত জাগে'। একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যুর সম্ভাবনা। মৃত(?) বাবাকে ভুল চিহ্ন দিয়ে সনাক্তকরণ করার জন্য ছেলে অনিরুদ্ধকে এক মানসিক টানাপোড়েন ও বেদনার মধ্যে দিয়ে যাত্রা করিয়েছেন লেখক। শেষে বাবার মতো করে বেল বাজানোর শব্দে চমকে ওঠে পরিবারের সকলে। আলোচক, গল্পটির আরো বিস্তারের সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন।

এরপর চন্দননগরের ভ্রমণপিপাসু গল্পকার নীতিশা রায়  'মায়াজাল' নামক একটি শহুরে জীবনের গল্প পাঠ করেন অত্যন্ত ধীর স্থির ও মৃদু কন্ঠে। নাম পরিচয়হীন কেন্দ্রীয় চরিত্রটির মধ্যে শ্রোতারাও যখন ধীরে প্রবেশ করছেন, ঠিক তখনি চরিত্রটি ঠিক যেভাবে নিজেকে সকলের থেকে দূরে রেখে একাকী জীবনে গল্পটির চরিত্র হয়ে উঠেছে সেভাবেই অনেক প্রশ্ন শ্রোতাদের মনে রেখে গল্পটি শেষ হয়ে গেল। আলোচক, গল্পটির রহস্যময়তার কথা ও গল্পটির চলনপথের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।

বৈঠকের উপরোক্ত  চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ গল্পটি নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত দেন সাহিত্যিক, সুআলোচক গৌর বৈরাগী মহাশয়।

আসরের সপ্তম গল্প কাকলি দেবনাথের 'নিরাশার আশা' একটি আবেগ প্রধান গল্প। গল্পের নিরাশাবালার চরিত্রটি নির্মমভাবে আহত একটি চরিত্র। চরিত্রটির যে ব্যথা পূর্বে ছিল তা তার একলারই ছিল, সেই ব্যথায় যখন সবাই সাড়াও দিল ততদিনে তার ব্যথা বদলে গেছে। শেষপর্যন্ত বদলে যাওয়া সময়েও তার ব্যথা একলারই থেকে গেছে। আলোচক, গল্পটিকে সংসারের জলছবি বলেছেন। যে সংসারে মৃত্যুর জন্য স্বামী চুম্বন দেন স্ত্রীকে।

চুঁচুড়ার গল্পকার অরিন্দম গোস্বামীর গল্প 'তাসের ঘর' একটি সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত। গোলাপী বাড়িগুলোর ফাটল, সরকারি প্রতিশ্রুতি, মিতুলের পুতুল আর দিম্মার সংসার ভেঙে পড়া সবই ধরা পড়ছে, যার কারণ শহর আধুনিক হয়ে উঠছে। আলোচক, দুটি প্রজন্মর একসাথে বাড়ি ও খেলাঘর ভেঙে যাবার দৃশ্য দেখার কথা বলেছেন।

আসরের নবম গল্পকার চুঁচুড়ার রাজীব কুমার ঘোষ  'ঘোষ স্যারের গল্প' নামক একটি গল্প শুরু করেন এই বলে,'আলো মানে হাতি'। ধর্মান্ধতার শিকার যেসব মানুষ, হানাহানির সময়ে বাস্তুছাড়া বা প্রকৃতির রোষে ছিন্নমূল তাদেরই গল্পকার একই ফ্রেমে ফেলে এক রূপক চরিত্র বুনেছেন। তথ্য ও গল্প নির্মাণ এক্ষেত্রে চরিত্রের উর্দ্ধে উঠে এক নতুন ঘরানার গল্পের সূচনা করেছে তা বলাই বাহুল্য। আলোচক, গল্পটিকে, বিপন্নতার গল্প বলেছেন। আলোচক, গল্পটির চরিত্রগুলির নাম নির্বাচণের দিকে শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

আসরের শেষ গল্প পাঠের আগে, সাহিত্যিক সর্বানী বন্দ্যোপাধ্যায় এই তিনটি গল্প নিয়ে আলোচনা করেন।

চন্দননগরের গল্পকার শতদ্রু মজুমদার আসরের শেষে 'এক হাজার শব্দের গল্প'  নামক একটি কৌতুকধর্মী গল্প পাঠ করেন। গল্পটির প্রধান গুণ ছিল এর উপভোগ্যতা। আলোচক মানস সরকার বলেছেন, গল্প পাঠে স্যাটায়ার ছিল ও গল্প ল্যান্ডিংএর সময় টুইস্ট ছিল।

গল্পবৈঠকের তিন বছরের পথচলার ইতিহাস ও গল্পকারদের গল্পজীবনের পরিচয় দিয়ে সাজিয়ে অনুষ্ঠানটিকে গেঁথেছিলেন সঞ্চালিকা মৌসুমী ঘোষ। এটি ছিল কলকাতার বাইরে গল্পবৈঠকের চতুর্থতম জেলা সফর এবং হুগলী জেলায় দ্বিতীয় সাহিত্য আড্ডা।
রিভিউ লিখলেন মৌসুমি ঘোষ