বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৭

“গল্প বৈঠক বর্ষবরণ - ১৪২৪”

এই সময়, ২২শে এপ্রিল ২০১৭ শনিবার



২২শে এপ্রিল, ২০১৭, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল শিল্প ও সাহিত্যের এক অনন্য মেলবন্ধন। বেহালা ফাইন আর্টস সোসাইটির পক্ষ থেকে এখানে আয়োজন করা হয়েছে বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনী, ২১শে এপ্রিল থেকে ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ পর্যন্ত। জলরঙ, চারকোল এবং ক্যানভাসের ওপর আক্রিলিক রঙে আঁকা অনিন্দ্য সব চিত্রকলায় প্রাণ পেয়েছে শিল্পী মনের নিভৃত দর্শন। চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে কেবলই মনে হচ্ছিল শিল্প এবং শব্দ যুগপৎ পথ চলতে পারে। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন প্রেমাংশু মিত্র, সমীর কর্মকার, তপন ভট্টাচার্য, গৌতম চৌধুরী, নিলয় কান্তি বিশ্বাস, অপূর্ব মজুমদার, বিশ্বজিত পাল, সঞ্জু মান্না এবং সত্যব্রত কর্মকার।
তাঁদেরই আমন্ত্রনে ২২ শে এপ্রিল বিকেল চারটে থেকে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে আয়োজিত হল “গল্প বৈঠক বর্ষবরণ - ১৪২৪”। শিল্পী বন্ধুদের গল্প বৈঠকের তরফ থেকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ এবং অশেষ কৃতজ্ঞতা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, এক বছর আগে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সেন্ট্রাল গ্যালারিতে, বেহালা ফাইন আর্টস সোসাইটির বন্ধুদের সাহচর্যে ও সহযোগিতায় আয়োজিত হয়েছিল প্রথম গল্প বৈঠক। তাই “বর্ষবরণ” কথাটি এখানে দ্ব্যর্থবোধক, অর্থাৎ, গল্প বৈঠকের এক বছর পূর্তি এবং নতুন বাঙলা বছর ১৪২৪ কে সাদর আবাহন।




 গল্প বৈঠকের থিম সঙ গেয়ে অনুষ্ঠানের সুচনা করলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, জয়া চৌধুরী এবং অয়ন চৌধুরী। গানটির কথা অয়ন চৌধুরীর এবং সুর ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের । এদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ছিলেন ভ্রামণিক, সম্পাদক এবং সাহিত্যিক শ্রী অমরেন্দ্র চক্রবর্তী। তাঁর উপস্থিতি এবং মূল্যবান মতামত গল্প বৈঠককে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করল। তিনি বলেন, লেখকের সাধনা একাকী, অন্তরালে। নিজের গভীরে ডুব দিয়ে তাঁকে খুঁজে আনতে হয় কিছু শব্দ, যা অন্য মানুষদের আলো দেখায়, তাই লেখকের দায়িত্ব অনেক। তাঁর বক্তব্যে তিনি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন মেয়েদের লেখালেখির কথা। তাঁর মতে মেয়েদের লেখার ভাষা এখন অনেক বলিষ্ঠ ও অসঙ্কোচ। তাদের লেখার মধ্যে শোনা যাচ্ছে তাদের নিজেদের লড়াইয়ের গল্প, ফুটে উঠছে তাদের নিজস্ব স্বর, নিজস্ব দৃষ্টি। শ্রী চক্রবর্তী পাঠ করলেন তাঁর নিজের কবিতা “ধর্না” - পরমকল্যাণের পথ চেয়ে অন্তহীন অপেক্ষায় থাকা।


গল্পে, কবিতায় গল্প বৈঠকের আসর জমে উঠেছিল। 

রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের  “নেইবাবুদের গল্প” আসলে সরকারি নেইবাবুদের নিয়ে লেখা একটি পরম উপাদেয় স্যাট্যায়ার। এই  নেইবাবুরা সরকারি খরচে ন্যায্য এবং অন্যায্য সব সুযোগ সুবিধা নেবার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত কিন্তু কাজের কাজ করার বদলে এনারা করে চলেন “নেই কাজ”, অর্থাৎ যে কাজের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, যা কিছু শুধু খাতায় কলমে। লেখাটি আদতে একটি ব্ল্যাক হিউমার যা একটি গভীর সমস্যাকে হাস্যরসের মোড়কে পরিবেশন করে।

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিতের গল্প ন্যুড স্টাডি, একটি অসাধারণ গল্প যার মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি স্তর। ক্লাস সেভেনের একটি ছেলে তার অমলিন দৃষ্টিতে মাকে স্বল্পবসনা অবস্থায় স্নানরত দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার জীবনের প্রথম ন্যুড ছবিটি আঁকে। গল্পটির শেষে এই অপ্রত্যাশিত মোচড়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। কোথাও যেন ফ্রয়েড সাহেবের ইদিপাস কমপ্লেক্স উঁকি মারে।

কস্তূরী চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা “কেমন আছ” একটি অতৃপ্ত ভালবাসার, মন কেমনের মেদুর কবিতা। সোনালির কবিতা “সংসার” আমাদের আটপৌরে জীবনে আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে থাকা ভালবাসার কথা বলে। দিনের শেষে এই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ।

পাপিয়া ভট্টাচার্যের গল্প “অসবর্ণ” গল্পে লেখিকা তার সহজাত সাবলীল ভাষায় নিম্নবিত্ত পরিবারের অশিক্ষিত, সাধারণ অথচ ব্যাতিক্রমি মেয়ে বুলির জীবনচিত্র একেছেন। সমাজ সংসার নির্দেশিত ভালমন্দের ধারণাগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি নিজের অন্তরে যা সত্য বলে অনুভব করে তাকেই অনুসরণ করে জীবনে। মেয়েটি অপ্রেম জানে না। অসুখী হয়েও সে ভালবাসা ঢেলে দিতে জানে। এর মূল্যও তাকে দিতে হয় সারাজীবন ধরে, নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে। তবু শেষ পর্যন্ত কোথাও যেন সে জিতেই যায়। আমরা যারা ব্যক্তিজীবনে নানারকম ভাবে আপোষ করতে করতে বেঁচে থাকি, তারা চমকিত হই মেয়েটির সততা ও চরিত্রের বলিষ্ঠতায়।

শাশ্বতী সরকার পড়লেন চারটি কবিতা। “আহ্বান” কবিতাটি রুপক ধর্মী।  সোনার ফসল ফলাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উষ্ণ মাটি ভালবাসার আহ্বান জানায় মেঘ ও বৃষ্টিকে। ‘সাধ’ কবিতায় পাই ভালবাসাকে ঘিরে অন্তহীন সাধ-স্বপ্নের আখ্যান। “স্বপ্নভুমির খোঁজে” কবিতায় ফুটে উঠেছে বিপন্ন সময়ের অসহায়তা। “অহল্যা” কবিতাটি অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলতে পেরেছে প্রতীক্ষা ও সমর্পণের কাহিনী।

নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লেখা প্রবীণা সাহিত্যিক শ্রীমতী কণা বসু মিশ্রের কবিতা “সত্তরের সেই দশক” ফুটিয়ে তুলেছে অস্থির সময়চিত্র - ছাত্র রাজনীতি, কাঁদানে গ্যাস, পুলিশের গুলি, খণ্ডযুদ্ধ। তবুও কবিতা, তবুও প্রেম বেঁচে থাকে সংগোপনে, বাঁচিয়ে রাখে সভ্যতার সবুজ বাগান।

বরেন্দ্রনাথ দাসের গল্প “বিপন্ন বার্ধক্য” আধুনিক সমাজের নিস্থুর অমানবিকতার ছবি তুলে ধরেছে, যেখানে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যেই স্বার্থপরতার শিকার হয় পরিবারের বয়োবৃদ্ধ মানুষজন।

সুস্মেলী দত্তের “চক্র” কবিতায় প্রেম আসে, প্রেম হারিয়েও যায় ঋতুচক্রের আবর্তনে। তবুও মনের কোণে তার রেশটুকু থেকেই যায়। “যাপন” কবিতাটিও প্রেমের কবিতা। প্রাত্যহিক জীবনের নানা ওঠাপড়া মধ্যেও জেগে থাকে প্রেম। রোজকার দিনগত পাপক্ষয়ে ভালবাসার অপেক্ষায় থাকাই আমাদের সার্থক যাপন।

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের গল্প “মণিডাইনি” এক ভূমিকন্যার অবহেলিত জীবনের কথা, তার স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস, বঞ্চনা, লড়াই, ক্রমাগত ব্যবহৃত হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কাহিনী। নিজের পরিবারের লিঙ্গরাজনীতি তাকে স্বপ্নপুরণের কোনও সুযোগই দেয় না। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হতে হতে সে একসময় ডাইনি বলে ঘোষিত হয়, তাও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। এই পোড়া দেশে এমন অনেক হতভাগ্য মেয়ের প্রতিনিধি হয়ে সে আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা যেন তার দিকে তাকাতে পারি না। কঠোর বাস্তব থেকে আহৃত এই কাহিনী আরও বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠে লেখিকার অনবদ্য পঠনভঙ্গিতে।

তৃষ্ণা বসাকের শক্তিশালী কলম আবার উপহার দিল একটি চমকপ্রদ গল্প “উকুন”। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রোতাকে চমকিত করতে করতে গল্পটি এগিয়ে যায় তার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। কি অনায়াস দক্ষতায় লেখিকা একসূত্রে গেঁথে ফেলেন কিছু আপাত বিচ্ছিন্ন বিষয়। সামান্য উকুন থেকে শুরু করে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সংশয়ের দোলাচলে ঝুলতে থাকা সম্পর্ক, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিজেকে নাঙ্গা করে ফেলার অসহায়তা, সত্য মিথ্যার দন্দ্বে বিপর্যস্ত মানুষের ব্যাক্তি পরিচয় পেরিয়ে গল্পটি পৌঁছে যায় শ্রেণীহীন সমাজের অলীক স্বপ্ন, ভয় বা সম্ভাবনার দিকে।

গল্প বৈঠকের আসরে বিশেষ ভাবে পাওয়া জয়া চৌধুরীর স্প্যানিশ অনুবাদ গল্প “সার্জেন্ট চেও লোপেসের মৃত্যু।” মূল কাহিনী সিরো আলেগ্রি (পেরু)। এক সাধারণ সৈনিকের মৃত্যুর খবরে তার প্রাক্তন সতীর্থ ও সহযোদ্ধার স্মৃতিতে ফিরে আসে যুদ্ধের কটুস্মৃতি, মৃত্যুর সঙ্গে ওঠাবসা করার সাতকাহন। মৃত্যু এ গল্পে একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার নিজস্ব গন্ধ আছে, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের সে সঙ্গ দেয়, পাশে থাকে। শবযাত্রায় সাধারণ সৈনিক টিকে স্যালুট জানানোর ইচ্ছে দিয়ে শেষ হয় গল্প। জয়াকে ধন্যবাদ, বিশ্ব সাহিত্যের এমন সব মণিমাণিক্যগুলিকে বাঙলা ভাষার পাঠকদের কাছে তুলে ধরার জন্য।

পারমিতা মুন্সীর কবিতা “বিবাহ প্রস্তাব” কবিতায় পাই একটি অভিনব বিবাহের প্রস্তাব। যৌথ জীবন, দাম্পত্য যেন একটা খেলা, বা প্রতিযোগিতা, বডি কনট্যাক্ট গেম, হাডুডু বা জুজুৎসুর মত। বিবাহের প্রস্তাব আসলে সেই খেলায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো। প্রস্তাবটিকে লোভনীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে এই কথা বলে যে, এখানে কোনও রেফারি নেই এবং প্রতিপক্ষ স্বেচ্ছায় হেরে যেতে রাজি।

অয়ন চৌধুরীর গল্প “ডিকেসি ১, ডিকেসি ২” কর্পোরেট জগতের এক টুকরো ছবি তুলে ধরেছে। একটু খাপছাড়া, অন্যরকম চিন্তাধারার মানুষ ডিকেসি এই জগতে চূড়ান্ত মিসফিট এবং সকলের উপহাসের পাত্র। এ জগতে ঘোষিত নীতির সঙ্গে মেলে না বাস্তবের নিরীক্ষা। ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে স্বাধীন চিন্তার কোনও মানুষের পা ফেলা মানতে পারেনা কেউ। আধুনিক সমাজমননের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে সেখানেও।

শর্মিষ্ঠা ঘোষের গদ্য কবিতা “কাল্পনিক” তুলে ধরেছে রোজকার জীবনসংগ্রামে বিদ্ধস্ত মানুষটির ফেসবুকে ছদ্ম প্রোফাইলের আড়ালে মুক্তি খোঁজার কাহিনী। গল্পটি খুব চেনা। আমরা সকলেই তো কোনও না কোনও ভাবে এই এসকেপিসম আশ্রয় করে বেঁচে থাকি।

কৃষ্ণা রায়ের গল্প “টান” মানবমনের চিরন্তন টানাপোড়েনের গল্প যেখানে সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনায় উদ্বিগ্ন মাতৃসত্তা মেয়ের কমপ্যাশনেট গ্রাউনডে চাকরি হবে ভেবে স্বামীর মৃত্যুকামনা করতেও পিছপা হয় না। সময় বদলে দেয় সবকিছুই। স্বামীর প্রতি ভালবাসার টান থেকেও অনেক শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায় সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা। কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে গিয়ে একাকার হয়ে যায় সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের বোধ। আশাপূর্ণা দেবীর তীব্র বাস্তবধর্মী গল্পগুলির তিক্ত কষায় স্বাদ স্মৃতিতে ফিরে আসে যেন!

কৃষ্ণা দাসের গল্প “অসুখ” তুলে ধরে এক মনোবিকলনের কাহিনী। আপাতভাবে সুস্থ স্বাভাবিক স্মার্ট ঝকঝকে ছেলেটি টেলিফোনে কথা বলে চলে তার মৃত প্রেমিকার সঙ্গে। আধুনিক জীবনের ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে মনের ওপর চাপ বেড়েছে অনেকগুন। সেই সঙ্গে প্রেমিকার মৃত্যুজনিত ডিপ্রেশন, মেলাঙ্কোলিয়া। ফলে ছেলেটি মনের ভারসাম্য হারায়। অসুখ কি আসলে শুধুই ঐ ছেলেটির?

তমালী রায় পাঠ করলেন তিনটি কবিতা। “ঈর্ষা” কবিতাটি বলে, অন্যের ঈর্ষা অর্জন করতে হলেও যোগ্যতার প্রয়োজন। ঈর্ষা কবিকে আরও দৃঢ় করে তোলে । “প্রহর” কবিতায় পাই, সারাদিনের নানা কাজের ফাঁকে কিছু নির্জন অপার্থিব মুহূর্ত যত্নে তুলে রাখা থাকে ভালবাসার জন্য, যা মনের মেঘ কাটিয়ে নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে দেয়। “আধুনিকতা” কবিতায় বলা হয় আধুনিকতার সঙ্গে সমান্তরালে বয়ে চলা অস্থিরতার কথা।

ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প “কুহক” তুলে ধরে মানবমনের আর এক জটিল গোলকধাঁধার কথা। বিপত্নীক বৃদ্ধ একটি অল্পবয়সী মেয়ের চেহারায় তার মৃতা স্ত্রীর চেহারার কিছু মিল খুঁজে পেয়ে বারবার তাকে দেখতে চাইতেন, মেয়েটির সঙ্গলাভের আশায় নয়, তার স্ত্রীকে ফিরে দেখার বাসনায়। এভাবেই যেন সময়কে হারিয়ে দিয়ে স্ত্রীর মৃত্যুকে অস্বীকার করতে চাইতেন তিনি।

বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প “মৃত্যু”। আত্মসর্বস্ব মানুষ হারিয়ে ফেলছে মানবিকতার বোধ। এমনকি পথেঘাটে কারও মৃত্যু ঘটেছে শুনলেও সে কোনও আগ্রহ বা কৌতূহল বোধ করে না, শুধু নিজের অসুবিধার কথা ভেবে কিছু ক্ষোভ আর বিরক্তি উগরে দেয়। মেট্রো রেলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে গেছে হঠাৎ। যার ফলশ্রুতিতে এই সমস্ত ভাবনা মনে আসে অরুনাংশুর। পরে জানা যায় মৃত ব্যক্তিটি তাঁর নিজের সন্তান। শুধু যে অন্যের প্রতি মানবিক বোধেরই মৃত্যু ঘটেছে তা নয়, আত্মসর্বস্ব জীবনে মানুষ সন্তানের মনের খবর রাখতেও ব্যর্থ, মৃত্যুর করাল ছায়া এতটাই বিস্তৃত আমাদের জীবনে, এমনই একটি ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয় গল্পটি।



    অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সঞ্চারী চক্রবর্তী। তাঁর সুললিত কণ্ঠে দু’কলি রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শেষ হল দ্বাদশ গল্পবৈঠকের আসর।

পরিশেষে আরও একবার উল্লেখ করতে হয় বেহালা ফাইন আর্টস সোসাইটির শিল্পী বন্ধুদের আন্তরিক আতিথেয়তার কথা। গল্প বৈঠকের প্রত্যেক সদস্যকে পুস্পস্তবক দিয়ে অভিবাদন জানানো থেকে শুরু করে ভেজিটেবিল চপ এবং চা দিয়ে আপ্যায়ন। আমরা অভিভূত, আপ্লুত, মুগ্ধ। তাঁদের সকলের জন্য গল্প বৈঠকের তরফ থেকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা। শিল্প সাহিত্যের এই মেলবন্ধন দীর্ঘস্থায়ী হোক, এই কামনা করি।


 ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন

শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭

গল্পবৈঠক একাদশ

শিলাদিত্য পত্রিকার  মে ইস্যু তে গল্প বৈঠক একাদশের কথা 





বার গল্পবৈঠকের একাদশ অধিবেশন হয়ে গেল গত ২৫শে মার্চ, কথাশিল্পী শরতচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত অশ্বিনী দত্ত রোডের বাসভবনে। এবারের গল্পবৈঠকে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছিলেন নবনীতা দেব সেন। অণুগল্প পাঠ করলেন উদীয়মান দশ গল্পকার। ছোটগল্প পড়লেন দুজন। প্রতিটি গল্পের আলোচনায় ছিলেন প্রবীণ গল্পকার কণা বসু মিশ্র এবং এ প্রজন্মের গল্পকার তৃষ্ণা বসাক। গল্পপাঠ শেষে একটি আলোচনা চক্রে অংশ নিলেন চারজন। আলোচনার বিষয় ছিল "ফেসবুকে সাহিত্য"  সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অয়ন চৌধুরী। 
শুরুতে শ্রদ্ধেয়া নবনীতা দেব সেনের সাবলীল আলাপচারিতায় উঠে এল কিছু জরুরী কথা। তাঁর স্নেহের উপদেশ  একটি ছত্রে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র ।
"আমার প্রথম বই বেরোয় ১৯৫৯ সালে। মানে ধরো ষাট বছর হল লেখা শুরু করেছি। আমরা যখন লিখতাম সবাই একা একাই লিখতাম। লেখা পত্রিকার ঠিকানায় পোষ্ট করতাম। আমরা যারা লেখালেখি করতাম চুপিচুপি, কখনও বা বন্ধুকে দেখাতাম। কোনোদিন পকেটে কবিতা নিয়ে বন্ধু চলে আসত। যারা লেখে তাদের সঙ্গে আলাপ হত। আমি কি লিখলাম তুই দ্যাখ, তুই কি লিখলি আমি দেখি। আমাদের একটা জগত ছিল খুব ব্যক্তিগত। আমরা পরস্পরকে ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করতাম। বিশ্বাস করতাম। কোনও সমালোচনা সসম্মানে বিশ্বাস করে গ্রহণ করতাম। আমরা পরস্পরকে সত্য কথা বলতে পারতাম। কোনও অপমানবোধ ছিলনা। কাজেই মতামত দিতে দ্বিধা ছিলনা। লেখা নিয়ে এ ওর বাড়ি চলে যেতাম। কোনোদিন আমি হয়ত তারাপদর বাড়িতে রাতে শুচ্ছি। বলতে পারতাম একে অপরকে – দ্যাখ, এটা হয়নি। এই শব্দটা এই হলে ভালো হত। বা এই লাইনটার বদলে এটা হলে ঠিক হত। সুনীল সারাক্ষণই আমাদের বলেছে, এবং আমরাও বলেছি। প্রথম প্রথম সংকোচ হত। তবে আমাদের ব্যপারটা আলাদা ছিল। গোষ্ঠীবদ্ধ ছিলামনা। আমাদের নিয়মিত বসা, জড়ো হওয়া, একটি ঘর ঠিক করে সেখানে সভাসমিতি ডাকা, কোনও প্রশ্ন উঠছেনা। খুব ব্যক্তিগত ছিল। গভীর গোপন। নিজের একটা লেখা নিজে কাউকে পড়ে শোনাবো, এ আমাদের ভাবনার বাইরে। লিখে ফেলে রাখতে হবে। অনেকদিন পর হয়ত আবার পড়লাম। খাতায় রয়ে গেলো। আবার পড়লাম। এইভাবে আমাদের লেখা হত। নিজের লেখা নিজে পরব এটা আমরা ভাবতে পারিনি। এটা ভীষণ লজ্জার ব্যপার। ওই হয়ত টেবিলের ওপর ভাঁজ করে রাখা কাগজ রেখে বলেছি – পড়। তখন আমাদের ব্যক্তিগত প্রচারের ইচ্ছেটা খুব কম ছিল। প্রচারধর্মী একটা সাহিত্য জগত যেখানে আমার ভয় করে। প্রচারের কথা ভেবে ভয় করে। এত প্রচারধর্মী হলে আমরা ভাববো কখন? আমাদের মুখটা বাইরের দিকে হয়ে যায়। ও কি বলছে, ও কি বলছে, ও কি বলছে। ফেসবুকে এখন লাইক দেয়। আনলাইক বা ডিসলাইক দেওয়ার জায়গা নেই কিন্তু। কেউ কেউ একটা পোষ্ট করে আকুল হয়ে থাকেন। কটা লাইক পড়ল। আমি যত দেখি এই প্রচার ব্যাকুলতা তত আমার বুকটার ভেতরে একটা কষ্ট হয়। আমি সমালোচনা করছিনা। যখন যে যুগ। এখন গল্প উপন্যাসের সময় নেই। এখন অনুগল্পের যুগ। সময়ের সঙ্গে মানাতে হবে। হয়ত এখন যারা লেখেন তারা আরও ভালো লিখতে পারতেন। আরও মনোযোগ দিতে পারতেন। আরও সূক্ষ্মভাবে ভাবা হত। এত বড় দলে পড়া হয়না। আলোচনা হয়না। এ তো সভা! সবাই বলে বাঃ, বেশ!  আমি মনের কথা বলছি আপনাদের। পরস্পরের পিঠ চাপড়ে কোনও সাহিত্য হয়না। আপনাদের মধ্যে যারা যারা সত্যি সত্যি লিখতে চান, তারা নিজের মধ্যে একটু ডুব দিন। বহির্মুখী হলে কখনও কোনও শিল্প চরম সত্যে পৌঁছয়না। যারা অন্তর্মুখী তারা অনুভব করতে পারে। বহির্মুখী হলে আমি যে কতটা দিতে পারি তা বোঝা হয়না। বুঝতে সুযোগ দেয়না আমাদের বন্ধুরা। পাঁচটা কবিতার বই সামনে খুলে পড়ে পড়ে একটা চমৎকার কবিতা লিখে ফেললাম। এটা চলে না। নিজে নিজেকে বলতে হবে। নিজের মানোন্নয়ন খুব জরুরি। আত্মতৃপ্তি থাকলে আমরা বড় জোর দোতলায় উঠতে পারি। কুড়িতলায় ওঠা আর হবেনা। আত্মতৃপ্তি বিষ। সেটা একটা মুহূর্তের। আমি একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে মনে করি যে আমাদের সময় এটা ছিলনা। আমরা খুব সৌভাগ্যশালী। বকুনি খেতাম আবার লিখে আনতাম। এবার ভালো হচ্ছে? হ্যাঁ এবার ভালো হচ্ছে। একটা গভীর আত্মবিশ্বাস থাকলে সমালোচনা গায়ে লাগেনা। যদি কেউ নিন্দে করে সেটাও বুঝতে পাড়া যায়, যে এ নিন্দে করছে, সমালোচনা করছেনা। আজ এ পর্যন্তই থাক। আবার কথা হবে, আলোচনা হবে। ভালো থাকুন সকলে"
এবার আসি গল্প বৈঠক প্রসঙ্গে। 




 গল্পবৈঠক সমমনস্ক কিছু লেখকদের একটি বৈঠক যেখানে পরস্পরের গল্প পাঠ ও আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের দুর্বল ও সবল জায়গাগুলো উপলব্ধিতে আসে। এবং অগ্রজ সাহিত্যিকদের পরামর্শে নিজেকে আরও কিভাবে উন্নত করা যায় সেই নির্দেশও ধারণা হয়। একে ঠিক সভা সমিতি বলা চলেনা। এখানে কোনও পুরষ্কার প্রদান হয়না। হয়না কোনও পত্রিকা প্রকাশ বা বই সংকলন।  আমাদের শ্রদ্ধেয় শ্রীমতী কণা বসুমিশ্র ছিলেন আলোচকের ভুমিকায়। তাঁর সহকারী ছিলেন তৃষ্ণা বসাক।  গল্পের  আলোচনায় আসি। পারমিতা মুন্সীর গল্পে পলাশ চরিত্রটি মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের শিকার। কল্পিত চিঠি ও চিঠির প্রত্যুত্তরে গল্পের উন্মচন। শেষ পরিণতিতে সমাজের নানা প্রতিকুলতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার কষ্ট স্পষ্ট হয়। তমালি রায় পরিবেশন করলেন দুই সমকামী যুবকের একজনের রূপান্তরকরণ ও বিয়েতে পরিণতি। সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এ এক ইচ্ছাপূরণের গল্প। শ্বাশ্বতী সরকারের গল্পে এক নারীর আত্মসংলাপ। সারাটা জীবন যেখানে অসুস্থতা ও মৃত্যু ছায়া ফ্যালে। দূরত্ব বাড়ায় আত্মজনের সঙ্গে। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের গল্পে অপরাজিতা দেবী যদি সত্যিই মেলের উত্তরটি দিতেন তবে মনে এক আশা জাগত। আহা যদি সত্যিই এমন হত! বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে মৃত্যুতেই একটি প্রেমের আভাস রয়ে গেলো। যে রয়ে গেলো তার মনে চিরকালীন এক অনুভূতি থেকে গেলো। কৃষ্ণা দাসের গল্পে দিদিমাকে নাতনির উপহার একটি মোবাইল। যার সুত্রে বৃদ্ধ বয়সে দিদিমার এক বৃদ্ধ বন্ধু হলেন। বয়সকালের একাকিত্বে মোবাইলের ইতিবাচক ভূমিকাটি সকলেই পছন্দ করলেন। রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প এপ্রিল ফুল। একে গল্প না বলে রম্যরচনা বলা চলে যা নিজগুনে মনোহরণ করে। জয়া চৌধুরী মুলত হিস্পানিক সাহিত্যের অনুবাদের কাজ করেন। তাঁর পঠিত গল্পটি অদ্ভুত তীব্র তরঙ্গ সৃষ্টি করে মনে। তাকে ধন্যবাদ এইসব সৃষ্টিকে তুলে ধরার জন্য। মহুয়া মল্লিকের গল্পে সাম্প্রতিক এক দুর্ঘটনার ছায়া। সে বড় কষ্টের। সেই কষ্ট থেকেও এক মহৎ অনুভব জাগে। ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে পরকীয়ার আকর্ষণ থেকে ফিরে আসা একটি মেয়ের কথা। নিত্যদিনের হরেক দায়িত্বের সঙ্গে জড়ানো মায়া। ভারী সুন্দর। যশোধরা রায়চৌধুরীর গল্পে এক অসুস্থ মানুষের কথা। যিনি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হাসপাতালে। স্মৃতি হাতড়ে মনে করছেন কিছু। একটি শুকনো লঙ্কার অনুসঙ্গে ফিরে এলো স্মৃতি। অসুস্থ মানুষটির ও লেখকেরও। অতনুপ্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প জন্মান্তর। মাছ হয়ে যদি জন্মাই! কিন্তু ফিরে আসতে কি সত্যিই ইচ্ছে করে? বিশেষত সত্যিটা যখন এমন দুঃখের।

শ্রোতার আসনে ছিলেন গল্পবৈঠকের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, অগ্রজা গল্পকার, ঔপন্যাসিক পাপিয়া ভট্টাচার্য। 

এমনই নানা গল্পের সম্ভারে জমজমাট হয়ে গেলো সেদিনের বৈঠক। আগামী বৈঠকের প্রতীক্ষায় তাই। 
  



প্রতিবেদনঃ অনিন্দিতা মন্ডল