শুরুটা হয়েছিল নিতান্তই সাদামাটা । পূর্ণেন্দু পত্রীর ভালোলাগা কবিতা মুখপুস্তিকায় পোস্টিয়ে 'আড্ডা' লিখেছিলো - “তোমার চিঠি আজ বিকেলের চারটে নাগাদ পেলাম /দেরী হলেও জবাব দিলে সপ্তকোটি সেলাম........আসবে কি সেই রেস্টুরেন্টে শীতাংশু যার মালিক?/রুপোলী ধান খুঁটবে বলে ছটফটাচ্ছে শালিক ।”সেখান থেকেই বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া । সুস্মিতা রায়চৌধুরী লিখলো - 'চিঠি নিয়ে একটা বৈঠক করলে কেমন হয় ?' সঙ্গে সঙ্গে সোৎসাহে উত্তর - 'হোক, হয়ে যাক তাহলে' । সোনায় সোহাগা হলো কলকাতার নামী লেখিকা ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের এদেশে উপস্থিতি । ঠিক হলো পত্রসাহিত্যের ডালি নিয়েই 'আড্ডা' ইন্দিরা আর দেবজ্যোতি চ্যাটার্জীদা-র সঙ্গে বৈঠকে বসবে উনিশে মে, রবিবার বিকেলে ! উনিশে মে দিনটি বিশেষ করে স্মরণীয় কারণ এই দিন ভাষা আন্দোলনের আর এক শহীদ দিবস । বাংলা ভাষার অধিকারের দাবীতে এ দিন আসামের বরাক উপত্যকায় রক্ত ঝরেছিল ।
প্রদীপ জ্বালার আগে সলতে পাকানোর কাজ শুরু হলো পুরোদমে। পত্রবৈঠকের আয়োজন হবে আর রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ মনে পড়বে না - তাও কি হয় ? সেই যে 'চরণতলাশ্রয়ছিন্ন' মৃণাল নিজের মতো করে বাঁচার আনন্দ তার চিঠির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে দিয়েছিলো, সেখান থেকেই তো বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক পত্রসাহিত্যের শুরু । তারপর তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন বুদ্ধদেব গুহ - 'সবিনয় নিবেদন' । পত্রবৈঠকের আগের সপ্তাহে প্রতিদিন ‘আড্ডা’ প্রকাশ করেছে সুপরিচিত লেখক /লেখিকার পত্রসাহিত্য । ছিলেন শামসুর রহমান, তসলিমা নাসরিন, রাজা সিংহ এবং এমন কি সলিল চৌধুরী !
বাঙালী ভোজনরসিকও বটে, সাহিত্যরসিকও বটে । এহেন বাঙালির মনোরঞ্জন করার জন্য ‘আড্ডা’ এক অভিনব উপায়ে পত্রবৈঠকের খাদ্যতালিকা পেশ করে । সে এক রূপকথার কাহিনী যেখানে ভোজনরাজ্যে রাজকন্যা লুচির স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত থাকেন রাজকুমার ছোলার ডাল, মহারাজ ডিম্ব, প্রেমিক মালপোয়া কুমার । সুরসিক পাঠক পাঠিকা তৎক্ষণাৎ লক্ষ্য করেন লুচিকুমারীর আবাল্য সহচর রাজকুমার আলুর অনুপস্থিতি । জয়শ্রী পাইন প্রশ্নবাণ হানেন - 'রাজকুমার আলুর কি দম ছুটিয়া গিয়াছে ? সভায় অনুপস্থিত দেখিতেছি ?' এর পরের কাহিনীটি বিরাট । কেবল এইটুকু বলি, জনসমর্থনের চাপে পড়ে ভোজনরাজ, রাজপুত্র আলুকে স্বয়ম্বর সভায় শেষমুহূর্তে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন । আলু রাজকুমার একটি ধুরন্ধর কূটনীতির চালে মালপোয়া কুমারকে ধরাশায়ী করেন ও রাজকন্যা লুচির বরমাল্য লাভ করেন । বিশদ বিবরণের জন্য ‘আড্ডা’র মুখপুস্তিকা দ্রষ্টব্য ।
পত্রবৈঠক বসেছিল দুপুরবেলা, সবুজ ঘাসে ছাওয়া, খোলা ব্যাকইয়ার্ডে, গাছগাছালির মাঝে, পাখির কূজনকে সঙ্গী করে । প্রকৃতিদেবী দুহাত ভরে দিয়েছিলেন তাঁর আশীর্বাদ । রোদ্দুরে ধোয়া দিন, প্রথম গ্রীষ্মের মনোরম আবহাওয়া আর ব্যাকড্রপে ‘আড্ডা’র ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, ফুটবল, মাছের ছবি আর আল্পনা - বৈঠকের সব আয়োজনই সারা । বিদিশা মুখোপাধ্যায়ের নিটোল মিষ্টি গলায় বেজে উঠলো - 'একটা গান লিখো আমার জন্য' । তারপর অমায়িক দেবজ্যোতিদার হাতে মাইক, তিনি উৎসাহ যোগালেন আরো আরো লেখার জন্যে, যাতে আরো আরো এমন বৈঠকের আয়োজন করা যেতে পারে ।
ইন্দিরার বক্তব্যে প্রথমেই ছিল উনিশে মে, এই দিনের বৈশিষ্ট্য, ভাষা শহীদ দের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ্য । ইন্দিরা বরাবরই নতুন লেখকদের পৃষ্ঠপোষক । আমাদের উৎসাহ দিলো । নতুন লেখা লিখে নিয়মিতভাবে এমন পাঠের আসর আয়োজন করার গুরুত্ব যে কতখানি - সেটা বারবার মনে করিয়ে দিলো । ইন্দিরার অকুন্ঠ প্রশংসায় ‘আড্ডা’র এই প্রচেষ্টা ধন্য হলো । চন্দ্রিমা বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ল নিজের বান্ধবীর লেখা চিঠি, সাহিত্যরসে ভরপুর । সম্পাদিকা অনসূয়া সেন ছোট্ট বক্তব্যে নিজের জাত চেনাল, পরিচয় করিয়ে দিল 'সংবাদ বিচিত্রা'র সঙ্গে । নতুন নতুন লেখা পাঠাতে অনুরোধ করল । আমরা উৎসাহিত হলাম, সম্মানিত হলাম । সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় বলে ওর সব লেখারই উৎস নাকি কোন না কোন দু:খ । পত্রবৈঠকে পাঠ করা ওর লেখাটি মানুষের মান আর হুঁশটাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেলো । মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী এসেছিলো তিনটি ভিন্নস্বাদের চিঠি নিয়ে । তার একটিতে মা তার এখনো-ভূমিষ্ঠ-না-হওয়া গর্ভের সন্তানকে লেখা চিঠিতে মনের আগল খুলে দেয় । আরেকটি চিঠিতে থাকে দ্রুতগামী পৃথিবীকে দূর থেকে দেখা আর অনুভবের মায়া । এরপর ইন্দিরা । তার নিজের উপন্যাস কলাবতী কথা থেকে পড়ে শোনালো নতুন দেশে গিয়ে এক মেয়ের বিস্ময়ভরা চিঠি, তার মাকে লেখা । সে চিঠির ছত্রে ছত্রে জেগে ওঠে এক অন্ত্যজ মেয়ের চোখে দেখা এক নতুন পৃথিবী - বিস্ময়ে জাগে আমার প্রাণ । পদ্মাসনা বন্দ্যোপাধ্যায় এলো তার মায়ের লেখা পত্রসাহিত্যের উপহার নিয়ে । স্বদেশে বসে এক প্রজন্ম আগের লেখিকার কলমে সে গল্প আমাদের গতানুগতিক ফীল-গুড ভাবনাচিন্তা কে আপাদমস্তক ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায় । মাকে লেখা এক মেয়ের চিঠি, যে মেয়ে শুয়ে আছে মর্গের ঠান্ডা, হিমশীতল ঘরে । জীবন থেকে পাওয়া বঞ্চনা আর যন্ত্রণার কথা মা ছাড়া আর কাকেই বা সে বলবে ? মায়ের লেখা গল্প-চিঠি পাঠ করলো বিদেশবাসী কন্যা । জীবনের কোথাও এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো ।
এরপর ভোজনরাজ্যে নিমন্ত্রণ রক্ষার পর্ব, যদিও সংক্ষেপে, কারণ সময় কম, সাধ অনেক । লুচিকুমারীর স্বয়ংবর সভায় ছিল শব্দছক, ছিল সাহিত্য নিয়ে প্রশ্নোত্তরের আসর । সুরসিক শুদ্ধসত্ত্ব আচার্য তার প্রশ্নবাণে শ্রোতাদের ধরাশায়ী করতে চেয়েছিল কিন্তু পেরে উঠলো না । শ্রোতারা যারপরনাই বুদ্ধি ধরেন ।
পত্রবৈঠক এবার দ্বিতীয়ার্ধে, দ্বিতীয় অধিবেশনের প্রথমেই অদিতি ঘোষ দস্তিদার তার ছেলেবেলার সই বিদীপ্তার কাছে চিঠিতে মন উজাড় করলো । দুই সখীর মান-অভিমান, আড়ি আর ভাব, স্কুলের সেই হালকা হাওয়ায় ভাসা দিনগুলি ফিরিয়ে দিলো শ্রোতার কাছে । ছেলেবেলা (নাকি মেয়েবেলা?) ফিরে পেলাম আমরা । সাহানা ভট্টাচার্য বাজলো এক্কেবারে অন্য সুরে । ছোট্ট তিন মিনিটের একটি লেখা, রসে টইটম্বুর । বক্তব্য - বঙ্গদেশ থেকে এক জননী তাঁর চির-অবাধ্য, পাঠে অমনোযোগী, কুলকলঙ্ক, বিদেশবাসিনী জ্যেষ্ঠাকন্যাটির মুখদর্শন করবার সুতীব্র বাসনায় শেষমেশ একটি স্মার্টফোন কিনে অতীব মনোযোগে হোয়াটস্যাপ শিক্ষা করে তাঁর ষষ্ঠীব্রত উদযাপন করলেন । সোফিয়া মিত্রর ছোট্ট লেখা । কিন্তু তাতে সব প্রবাসীর হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণার অভিব্যক্তি । প্রবাসে উন্নত কিন্তু কৃত্রিম দুনিয়ায় নিজেকে দামী মুক্তোর গয়নায় সজ্জিত করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চোখ যায় ঝাপসা হয়ে । মনে পড়ে যায় দূর দেশে পড়ে থাকা মা বাবার কথা, যারা শুক্তির মত সব যন্ত্রণা ভোগ করে তিলতিল করে গড়ে তুলেছে আমাদের ! সংগ্রামী লাহিড়ী তার লেখায় উনিশে মে র ইতিহাস তুলে ধরলো । সুস্মিতা রায়চৌধুরী তার নৃত্যানুষ্ঠান সেরে পত্রবৈঠকে পৌঁছতে পারে নি, কিন্তু তার লেখাটি সে 'আড্ডা'র ডাকবাক্সে ফেলে দিতে ভোলেনি । বড়ো মন-কেমন করা চিঠি, নিজেরই মনের সঙ্গে আলাপচারিতা, জীবনের ঝাঁপি উজাড় করে একাকিত্ব ভোলা - ঠিক যেন একটি বিষাদমধুর কবিতা ।
'আড্ডা'র প্রথম সাহিত্য-বৈঠককে স্মরণীয় করে রাখতে 'টিম আড্ডা' তৈরী করেছিল ম্যাগনেট । হাতে আঁকা 'আড্ডা'র লোগো, তার সঙ্গে বৈঠকের দিনক্ষণ - সবাই পেলেন একটি করে । ম্যাগনেট মনে করিয়ে দেবে খোলা হাওয়া প্রাণে লাগিয়ে সাহিত্য বাসরের সুখস্মৃতি । আর ইন্দিরা ও দেবজ্যোতি-দা কে সম্মান জানিয়ে উপহার ছিল কাঠের ফলক, একইরকম হাতে আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো ।
শেষে আবার ইন্দিরা । এবার তার নিজের লেখা একটি ছোট গল্প দিয়ে শেষ হলো পত্রবৈঠক । কিন্তু শেষ হয়েও যে হইল না শেষ ! গোধূলি আলোয় বসলো গানের আসর, সুর ছড়িয়ে গেল সাঁঝ আকাশে, পুকুর-ভরা টলটলে জলকে আলতো ছুঁয়ে, ইথার তরঙ্গে ভেসে বিলীন হলো মহাশূন্যে । রয়ে গেল ভালোলাগা, রইলো 'আড্ডা'র সংকল্প - আবার হবে, আবার আসবো গল্পের ডালি নিয়ে, আবার একসাথে মিলবো সবাই বাংলাভাষাকে ভালোবেসে ।
নিউজার্সি থেকে প্রতিবেদন টিলিখেছেনঃ সংগ্রামী লাহিড়ী