সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭

"মিতালি"র আয়োজনে ষোড়শ গল্পবৈঠকে কিশোর গল্পপাঠ এবং লাইব্রেরী উদ্বোধন




ক্ষিণ কলকাতার কালিকাপুরের অক্সফোর্ড স্কুলের আঙিনায় বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মিতালি-র আহ্বানে অনুষ্ঠিত হল গল্পবৈঠকের ষোড়শতম সাহিত্য বাসর।
মিতালি, একটি উজ্জ্বল প্রয়াস, যার লক্ষ্য নারী ও শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অপুষ্টি থেকে রক্ষা করা, এবং বঞ্চিত শিশুদের সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধি।
এঁরা সুন্দর করে মঞ্চ সাজিয়েছিলেন।অতিথিদের আপ্যায়ন এবং মিষ্টি মুখের আয়োজন করেছিলেন, এবং ছোটদের বই পড়ার অভ্যাসকে এগিয়ে নিইয়ে যাবার জন্য , একটি গ্রন্থাগারের উদ্বোধন ও করলেন এই অনুষ্ঠানকে সংগে নিয়েই । গল্প বৈঠকের সদস্য এবং মাননীয় অতিথিরা প্রত্যেকেই কিছু বই উপহার দিয়ে অংশভাক হয়ে রইলেন এই আনন্দের মুহুর্তটির ।
মিতালি-র পক্ষ থেকে একটি উদ্বোধনী সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সুরু করলেন সমগ্র অনুষ্ঠানটির ।


এরপর গল্প বৈঠকের অন্যতম আয়োজক শ্রীমতী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় সঞ্চালনার ভার তুলে দিয়েছিলেন সপ্রতিভ মঞ্চশিল্পী, অনুবাদক, এবং সুবক্তা সাহিত্যিক জয়া চৌধুরীর হাতে। জয়া মঞ্চে আহ্বান করে নিলেন, আজকের আলোচক সাহিত্যশিল্পী অতিথিদের।প্রখ্যাত সাহিত্যিক রতনতনু ঘাটি, বিনতা রায়চৌধুরী,বুবুন চট্টোপাধ্যায় এবং মহাশ্বেতা রায়কে মিতালির সদস্যরা মঞ্চে বরণ করে নেবার পর, জয়া চৌধুরী স্ত্রোত্র পাঠের মধ্য দিয়ে শুভারম্ভ করলেন এই বৈঠকি আড্ডার ।
প্রথমেই জনপ্রিয় গল্পকার দীপান্বিতা রায় গল্প পড়লেন । গল্পের নাম, চেনা ঠিকানা । দরিদ্র ট্যাক্সি চালক আনোয়ার, আর তার পরিবারে, অবাঞ্চিত মাতৃহারা কন্যা লক্ষ্মী, কেমন সহজেই আপন হয়ে অকালে নিহত মেয়েটির স্থান পূর্ন করে, জেনে মনে মধ্যে মমতার ঢেউ ওঠে । লেখিকা অনায়াস দক্ষতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি , মানবিকতা, কন্যা সন্তানের প্রতি আমাদের দায়িত্ব এই সব বড় বড় তত্ত্বকে বক্তৃতার মঞ্চ ঠেকে ঘরের উঠোনে নিয়ে এসেছেন। এই জল রঙে আঁকা ছবিটি বহুকাল মনে থাকবে।


বিখ্যাত সাহিত্যিক, শিশু সাহিত্যের দিকপাল শ্রী রতনতনু ঘাটি আলোচনা করলেন এ গল্পের। তিনি বললেন, এইটেই আজকের রূপ কথা। সত্যি তো  এ আমাদের ঘরের সিন্ডারেলার গল্পই বটে।আরও বললেন, সাহিত্য, বিশেষ শিশু সাহিত্যে মানুষের জয় হওয়া কতোটা জরুরি। শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল, “হোথা মাতৃহারা মা পাইবে চিরদিন---” কলমের জয় হোক ।
এরপরেই জয়া চৌধুরী ডাক দিলেন আমায়। অঙ্কের প্রতি ছোটদের আতঙ্ক, এবং তা কাটানোর জন্য আমার ছেলে মেয়ের সঙ্গে তাদের দাদু দিদার নানান মজার খেলা, সব বাচ্ছাদেরই চেনা লাগে। তাই ছড়ার নাম ছিল, সাত সতেরো । ছোট্ট শ্রোতাদের এক গাল হাসি, মন ভাল করে দিল।

এই ফাঁকে জয়া জানালেন গল্প বৈঠকের গোড়ার কথা। শ্রীমতী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, শ্রী অয়ন চৌধুরি, শ্রী নিলয়কান্তি বিশ্বাস কি ভাবে সাহিত্যের আদান প্রদানের জন্যেই গড়ে তুলেছিলেন এই আড্ডা।
গার্গী রায়চৌধুরী জানালেন ২০১২ থেকে মিতালির পথ চলার ইতিহাস।
এরপর জনপ্রিয় এবং রসিক লেখিকা তৃষ্ণা বসাক, কিশোর ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প রোবোর বাপের শ্রাদ্ধ গল্প ।  ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে রোবট সমাজ, মানুষের অভাব, অনুভূতি,প্রকৃতির সংগে আমাদের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব কি সাবলীল হাস্যরসে মুড়ে উপহার দিলেন।এবং উপসংহারে  সময় সাঁতারুর ইলিশ আনার ছোঁয়ায় সব বাঙালি মাত।
কিশোর ই-পত্রিকার “ইছামতী”র সম্পাদক, সাহিত্যিক শ্রীমতী মহাশ্বেতা রায়, কল্পবিজ্ঞানের এই গল্পটির বিভিন্ন দিকগুলি ছুঁয়ে, আধুনিক জীবনে প্রযুক্তি ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে মনোজ্ঞ মতামত রাখলেন।

এরপর, ছড়াকার হিসেবে এলেন নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত। নিবেদিতা তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গীতে ছড়ার ছন্দে ছোটদের জানিয়ে দিলেন, বৃষ্টি হলে ছোট মানুষের কত অসুবিধে। তার কিত কিত খেলা, বাবার জলদি বাড়ি ফেরা, সব ভন্ডুল। খালি অঙ্ক টিউশানির দিন এলে ভারি সুবিধে।
এরপরে মঞ্চে এলেন শ্রীমতী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় । তাঁর পুরাণ ছোঁয়া সরস রচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, রম্য রচনা বাঙালি পাঠকের বিশেষ পরিচিত।
ছোটদের জন্য তিনি নিয়ে এসেছিলেন গল্প, চিন্তামণি থটশপ। সেই দোকান যেখানে বুড়ো মানুষ চিন্তামণি বাবু, নানান রকম স্বপ্নের ক্রিস্টাল লজেন্সের মত বোয়েমে সাজিয়ে রাখেন। ল্যাবরেটরির বর্ননা, স্ট্যালাগমাইট, স্ট্যালাকটাইটের সৌন্দর্য, গ্লাস রডে গুলে যাওয়া স্বপ্নের রঙ, সব শেষে , অবিশ্বাসীদের থেকে দূরে স্বর্গের স্বপ্ন ছুঁতে চাওয়া একলা চিন্তামণি, সব মিলিয়ে এক সাতরঙা অপরূপ রামধনু। রসায়নবিদ লেখিকা নবরসের বেশির ভাগগুলিকেই সাজিয়ে দিয়েছেন এই আলোময় কাহিনীর মধ্যে।
আলোচনা করতে মঞ্চে সাহিত্যিক, সাংবাদিক বুবুন চট্টোপাধ্যায় তাই অবন ঠাকুর,লীলা মজুমদার এবং মানুষকে জিতিয়ে দেবার প্রসঙ্গ আনলেন। বললেন, “এমন কেন সত্যি হয়না আহা-”
পরবর্তী গল্প পাঠে এলেন বৈঠকের আরেক আয়োজক , সাংবাদিক , সাহিত্যিক অয়ন চৌধুরি । তিনি মনে করিয়ে দিলেন এ দিনটি মাদার টেরিজার পুণ্য জন্ম তিথি, এবং পথের পাঁচালি দিবস ও ।
তাঁর গল্পের নাম; স্বাধীনতা ।অবাঙ্গালি রঘুনাথ কুমারের মাতৃহীন ছেলে চতুর্থ শ্রেণীর ছোটুর ঘুড়ির সুতোর বায়না, তার বাবার জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান , আত্মসচেতন হয়ে ওঠা বাপ ও ছেলে , জীবন্ত হয়ে ওঠে শব্দ বিন্যাসে। অন্যাইয়ের সংগে আপোষ না করার স্বাধীনতা মিলে মিশে যায় ছেলের ইচ্ছেসুখে ঘুড়ি ওড়ানোর স্বাধীনতার সংগে।
আলোচনায় বিখ্যাত লেখিকা বিনতা রায়চৌধুরি প্রথমে বই এবং গ্রন্থাগারের প্রতি ভালবাসার কথা জানালেন। পরে বললেন , গল্পটি বড়দের জন্যেও কত উপযোগী ।
এরপর, জনপ্রিয় কবি সুস্মেলি দত্ত, ছড়া পড়লেন, উলট পুরাণ । ছন্দের জাদু খুশি করে দিল ছোট বড় সবাইকে।

চা সিংগারা সহ জলযোগের বিরতিতে, মিতালির ছোটরা সবার হাতে পৌঁছে দিল গোলাপ ফুল এবং নিজেদের হাতে বানানো অপুর্ব নান্দনিক কার্ড ।তারপর মঞ্চে এল মিতালির পরিশ্রমের ফসল। নীল সাড়ি , সাদা বন্ধনীর সাজে চার কিশোরী যে অপূর্ব মুদ্রা ও নৃত্যশৈলীতে নেচে গেল, “মন মোর মেঘের সঙ্গী –” অনেক খ্যাতিসম্পন্ন নাচের মহলকেও তা হার মানিয়ে দেবে। মুগ্ধ হলাম মিতালির এই কিশোর মানুষদের প্রতি যত্ন দেখে।


এরপর আবার গল্প। প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় লেখিকা মহুয়া মল্লিক পড়লেন কল্প বিজ্ঞানের গল্প , গ্রিন প্রোজেক্ট ।রোবট অদ্রিজর চোখে মানব জীবন , প্রকৃতি , ভালবাসা , সব কিছুকে ছোঁয়ার আকুলতা, স্নেহের জন্য আর্তি, আমাদের মায়ায় ঢেকে দিল।
আলোচক শ্রী রতনতনু ঘাটি ও প্রশংসা করলেন গল্পটির ।
পরের বার মঞ্চে এলেন অন্যতম রসিক সাহিত্যিক , শ্রী রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ।তাঁর লেখার অনাবিল হাস্যরস এই সময়ের মানুষকে আনন্দে রাখে । আজকের লিমেরিক, “ আর পাগলামি নয়” ও সবার মুখে হাসি ফোটাল।
পরের গল্পকার , মউল পত্রিকার সম্পাদিকা , শ্রীমতী কৃষ্ণা দাস, কল্পবিজ্ঞানের গল্প শোনালেন।ভুন্ডুল আর গ্যামেটের আধ ঘণ্টা , গল্পটির কিছু অংশ পাঠ করে শোনালেন তিনি।
আলোচক মহাশ্বেতা রায়, জোর দিলেন ইংরাজি শব্দ কম ব্যবহারের ওপর, এবং কল্প বিজ্ঞান সব দেশের সাহিত্যেই কত বড় জায়গা নিচ্ছে, সেকথা ও জানালেন তিনি।
নতুন অতিথি তপশ্রী পাল, ছড়া পড়লেন, “ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল”।
কাগজ বিলি করা গরিব ছেলে বঙ্কুর জাদুদন্ড পেয়ে দারিদ্রকে হারিয়ে দেওয়ার গল্প ছন্দে গেঁথে শোনালেন তিনি।
সব শেষ গল্পটি এল জনপ্রিয় গল্পকার ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের অপূর্ব এক মিষ্টি গল্পের জলছবিতে ফিরিয়ে নিইয়ে গেলেন মাটির কাছে, শিকড়ের টানে।বাবান ও হাঁসের ছানা – গল্পটি মুগ্ধ করল ছোট বড় সবাইকে। সহজ ভাষায় প্রকৃতি জীবন সব ধরা পড়ল তুলিতে আঁকা ছবির মত গদ্যে।
বুবুন চট্টোপাধ্যায় আলোচনায় বললেন এ গল্পের মাটির গন্ধ, মরমী দৃষ্টিভঙ্গীর কথা।
এরপর উপস্থিত সকলে নতুন লাইব্রেরীটির জন্য কিছু বই দিলেন। এবং কচিকাঁচাদের হাতে বই তুলে দিয়ে লাইব্রেরীর উদ্বোধন করলেন মাননীয় শিশু সাহিত্যিক রতনতনু ঘাটি।
শেষে অতিথি সাহিত্যিক শ্রী রতনতনু ঘাটি শোনালেন তাঁর মফস্বল ঠেকে এসে কলকাতা শহরের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠার গল্প।
মিতালির মিষ্টিমুখের আয়োজন সমাপ্ত করল এই সুন্দর সাহিত্য সন্ধ্যাকে।   



প্রতিবেদন লিখেছেন সোনালী

বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৭

" রিয়েল ভার্সেস ডিজিটাল আড্ডা " এই বিষয়ে কি মত তোমাদের?

সেদিন হঠাত মনে পড়ে গেল আমাদের পুরোণো বাড়ির দালানে বসে একজোট হয়ে তুতো ভাই বোনেদের সঙ্গে জমিয়ে কাঁকড়ার ঝাল দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা। কাঁকড়ার সুস্বাদু দাঁড়া চিবোতে চিবোতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। হাতের এঁটো হাতেই শুকিয়ে যেত তবু যেন আড্ডা ফুরতো না। কিসের এত আড্ডাই বা ছিল? কেন ই বা এত গল্প জমে থাকতো জানিনা বাপু। একটা কারণ অবিশ্যি নিয়মিত দেখা না হওয়া। সকলেই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকতাম। কোনো এক ছুটির দিনে একজোট হয়ে খাওয়াদাওয়া, হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠতাম সকলে মিলে। মাংসের হাড় নিয়েও কাঁকড়ার মত অবস্থা হত আমাদের। আর খাওয়ার পর হাত চাটা যেন শেষ ই হত না। চাটনীতে আঙুল ডুবিয়েই চলেছি আর গল্পের গোরু গাছে উঠে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। তখন কি আর জানি বাপু যে এই আড্ডা গিয়ে থমকে যাবে একদিন? এই গোলগল্প গুলো আছাড় খাবে  ফেসবুকের চৌকাঠে? তাহলে আরেকটু নাহয় আড্ডা দেওয়া যেত। ঠিক তেমনি মনে পড়ে কলেজ কেটে কফিহাউসের আড্ডার কথা। কবিতায় কথালাপ, হেঁয়ালির ছটা, মজার জোকস বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার আনন্দ। এই বাস্তব আড্ডার ঠেক এখন সোশ্যালনেটের এক চিলতে নীল অলিন্দ। আর সেখানে নিজের চেনা পরিচিত তুতো ভাইবোনরা যেমন আছে, আছে স্কুল কলেজের বন্ধুরা আর আছেন অপরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধব ও। তবে তথাকথিত আড্ডার বাতাবরণ কি মেলে এই ডিজিটাল গল্পের আড্ডাখানায়? সেখানে কি সম্পর্কের বেড়াজাল পেরিয়ে আলাপচারিতা ধাক্কা খায়? না কি  সম্পর্কের টানাপোড়েন কে উপেক্ষা করে নিমেষেই উবে যায় কর্পূরের মত। অথচ ফেসবুকের মত প্ল্যাটফর্মে কোটি কোটি মানুষ অহোরাত্র আড্ডা দিয়েই চলেছেন। 

তাহলে কি দাঁড়াল? 

হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন অথবা ল্যাপটপে কিম্বা ট্যাবের চ্যাটালাপই টিঁকে থাকবে? আর  মুখোমুখি বসে বাস্তব আড্ডাগুলো হারিয়ে যাবে সুপর্ণকান্তি ঘোষের সেই অমোঘ লিরিক্সের মধ্যে দিয়েই?  "কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই " বলে আমরা স্কাইপে, হোয়াটস্যাপে, ফেসবুকে চেঁচাতেই থাকব? 

এ বারান্দা থেকে ও বারান্দায় কাপড় তুলতে তুলতে কিম্বা শীতের রোদে বড়ি দিতে দিতে, অথবা ছাদে চুল শুকোতে গিয়ে কেউ কারোর মুখও দেখব না আর জিগেসও করব না? কেমন আছো গো? আজ কি রান্না হল তোমার হেঁশেলে? অথবা চলো না ঐ সিনেমার টিকিটটা কাটি।  
রোয়াকের আড্ডাও অপ্রতুল এখন। নেই সে রোয়াক ওলা বাড়ি, নেই সেই আড্ডাবাজ তরুণ তুর্কীরা। তা অবিশ্যি ভালোই একদিক থেকে। তরুণেরা কাজে ডুবে থাকাটা দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক। আর যে তরুণরা এখনো বেকার হয়ে ফ্যা ফ্যা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জটলা করে তারা কি বোঝে সোশ্যালনেটের মাহাত্ম্য? অগত্যা রাস্তাই ভরসা তাদের আড্ডা দেবার জন্য। কিন্তু সেটাও তো ঠিক নয়। নব্য প্রযুক্তির কাছে আবালবৃদ্ধবণিতা যখন হার মানেনি তারাই বা কেন স্মার্টফোন খুলে ফেসবুকে বন্ধুর মুখ দেখবে না? সেটা বরং ক্ষতিকর সমাজের পক্ষে। 

কি মনে করছে লোকজন? ব্যাঙের ছাতার মত কফির ক্যাফে হয়েছে আজকাল। তবুও সেখানে গিয়ে বন্ধুরা জমায়েত হয়ে নিজের নিজের স্মার্ট ফোন খুলে ফেসবুক খুলে বসে আছে। অথবা হোয়াটস্যাপে আলাপ চালিয়েই যাচ্ছে। কফির পেয়ালা পানতা হয়ে যাচ্ছে। বেয়ারা বিল মিটিয়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু প্রকৃত আড্ডা যেন মুখ লুকোচ্ছে সেখানেও ।
সেই নিয়েই পক্ষে ও বিপক্ষে অলোচনা হোক! জমে উঠুক শারদীয়া চক্র বৈঠক ! কমেন্ট বক্সে লেখা পোস্ট করুন!

সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭

পঞ্চদশ গল্প বৈঠকে ১৫ জনের গল্প পাঠ


ল্পবৈঠকের পঞ্চদশ আসর বসেছিল শেষ আষাঢ়ের এক মন কেমন করা বিকেলে, দক্ষিণ কলকাতার পাটুলি অঞ্চলে । না, কোন বাঁধাধরা সভা কক্ষে নয়, “নেশা’স কিচেন” নামে এক রম্য নিরিবিলি রেস্তোরায় আমন্ত্রিত হয়ে। শব্দসীমা বেঁধে রাখা অথচ টানটান সংবেদী গল্প পরিবেশনই সাধারণত এই বৈঠকের উদ্দেশ্য। সাথে অবশ্যই থাকে নির্ভেজাল আনন্দে ঘেরা মেধাবী আড্ডা। এবারের গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল সম্পর্ক। শুরুতেই স্তোত্রপাঠ করে শোনালেন কবি, স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ সাহিত্যজীবি জয়া চৌধুরি। নিমেষেই বাণিজ্যিক রেস্তোরাটি আমূল বদলে গিয়ে হয়ে উঠল এক পরিশীলিত সাহিত্য-সভা। আর তাতে বিশেষ মাত্রা সংযোজন করতে এগিয়ে এলেন গল্পকার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, উৎপল কুমার বসুর স্মরণযোগ্য বর্ষার কবিতা এবং জয় গোস্বামীর মুক্তগদ্য জলঝারি থেকে পাঠে বৈঠকটি আশ্চর্য, সপ্রাণ গতিতে সঞ্চালিত হতে লাগল। চোদ্দটি ছোট গল্প আর একটি ভীষণ মন ছোঁয়া শৈশব স্মৃতিকথার আবহে সময়ের দোলাচল সে ঘরে টের পাওয়া গেলনা। মেধায়, মননে, প্রতিভার বহু স্বরে সম্পর্ক নামক এক অমোঘ জীবনব্যাপী সঙ্গতা নিয়ে আমরা বুঁদ হয়ে শুনলাম গল্পগুলি। সম্পর্কের মাঝে সম্পর্কহীনতার গল্পও প্রবলতর দাবি নিয়ে এগিয়ে এল। আসলে অভাব না থাকলে স্বচ্ছলতা কে যে ঠিকঠাক চেনা যায়না। এদিনের গল্পের আলোচনায় ছিলেন সাহিত্যিক কাবেরী  রায় চৌধুরী।




আসরের প্রথম গল্পটি পড়লেন এদিনের অতিথি গল্পকার সুবীর বোস। 
গল্পের নাম অনন্ত কুয়াশা।মানুষের ব্যক্তিগত যাপন চিত্রে কত যে বিচিত্র বিষয় লগ্ন থাকে ! মানসিক মেদুরতা, রহস্য ভরা ঘটনা থেকে শুরু করে গভীর গোপন কত যুদ্ধ-- বলিষ্ঠ ভাষায় লেখক জানিয়ে দিলেন,স্বল্প পরিসরে গল্প কত তীক্ষ্ণ সূচীমুখ হয়ে উঠতে পারে। ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প বিষম এর পটভূমি বেশ সাম্প্রতিক এবং চিরকালীন। ধর্ম পরিচয় গোপন করা এক গৃহ পরিচারিকার অকপট সত্য ভাষণ, কি ভাবে যে সংশয়-দীর্ণ সভ্য তথা শিক্ষিত মানুষকে দ্বন্দ্ব ও অসহায়তার অতল গহ্বরে পৌঁছে দিতে পারে, সে কথা লেখক বড় যত্ন নিয়ে তুলে ধরেছেন।



কৃষ্ণা রায়ের গল্প পিতৃপ্রতিম এর বিষয়বস্তুতে তেমন চমক নেই, আছে সন্তানের জন্য চিরকালীন, সীমাহীন, অযৌক্তিক স্নেহের বেদনাঘন আবহ । স্বেচ্ছায় অকরুণ হয়ে এক সফল প্রতিষ্ঠিত পুত্র-সন্তান লোক সমক্ষে নিজের অসফল বাবাকে “বাপের বয়সী বিরক্তিকর মানুষ” বলে চিহ্ণিত করলেও কাঙাল পিতৃহৃদয় সেই টুকু সবীকৃতিকেই পরম প্রাপ্তি বলে আঁকড়ে ধরেন। আমাদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া দাবি করে মনোযোগ কখনো এক নাগাড়ে স্থায়ী হতে পারেনা। তাই প্রয়োজন হয় ক্ষণিক বিরতির। এই বৈঠকে গল্প দিয়েই ইন্দ্রিয়দের শাসন করা হয়।আর এ তো জানা কথা, যথেষ্ট ভারী বিষয়বস্তুও রচনার প্রসাদ গুণে স্নায়ুর চাপ নামিয়ে দেয়।


রজতশুভ্র বন্দোপাধ্যায়ের আঁতলামো ও মাতলামো শুনে শ্রোতা বন্ধুরা প্রাণ খুলে হাসলেন। দুই সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ বিষয়কে নির্বাচন করে রম্যতা, হাস্যরস, চমক, শ্লেষ, সমকালীন নাগরিক জীবন এর মিশেল দিয়ে কী স্বচ্ছন্দ গদ্য যে লেখা যায়, রজতশুভ্রের লেখা যারা পড়েছেন বা শুনেছেন, সে কথা তারা স্বীকার করতে বাধ্য। জয়া চৌধুরি বরাবরই গল্প অনুবাদের ক্ষেত্রে বিষয়-বস্তুটিকে প্রাধান্য দেন। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। বলিভিয়ার এক লেখকের স্প্যানিস ভাষার গল্পের অনুবাদ, বন্ধ দরজা শিরোনামের গল্পটির প্রতিটি পর্বে চমক পাঠক-শ্রোতাদের এক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হতে দেয় না। চূড়ান্ত পর্বে বাবা-মেয়ের এক বিচিত্র সম্পর্কের সামনে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হতেই হয়।

বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক গল্পে স্থায়ী দাম্পত্যের চেনা অন্বয় ও সমীকরণ অনায়াসে গল্পটিকে পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায় । নিজস্ব মানুষটির মধুমেহ রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর জেনে সদা সমালোচক ঝগরুটে স্ত্রী রসকলির উদ্বেগ উপভোগ করে হারাণ। স্ত্রীর কোমল , মমতাময় আচরণের পালাবদলের উৎসে যে রয়ে গেছে অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন মানুষের আমূল নির্ভরতা, তারই তাগিদে হয়তো বা দীর্ঘ দাম্পত্যে মধুর বাতাবরণ তৈরি হতে অসুবিধে হয়না। জীবনের এক ধূসর সত্য এ গল্পে সহজ ছন্দে উঠে এসেছে। টানটান মেদহীন গল্প উপহার দিয়েছেন পারমিতা মুন্সি তার অসম্পর্কের গল্পে। নব পরিণীতা অতীব সুন্দরী স্ত্রী যে আদতে অজস্র সম্পর্কে লগ্ন থাকা ছদ্মবেশী আই এস আই গুপ্তচর, সে কথা জেনেও প্রেমাকুল স্বামীর সংশয় যায়না। বিচার ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করে প্রতারক স্ত্রী আত্মঘাতী হলেও সবামী তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ গল্প কি সত্যিই অসম্পর্কের? নাকি সমাজ-মান্য সংলগ্নতাকে উপেক্ষা করে শাশ্বত জীবন-লগ্নতার দলিল?

সুগত চৌধুরির ছেঁড়া চিঠি এক বহু চেনা হৃদয় রেখার কাহিনী, বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা দুঃখিনী মায়ের লেখা চিঠি, মেরুদন্ড হীন পুত্র গৌতমকে তার জন্মদিনে। আপাত ভাবে চেনা ছকের গল্পের মধ্যেও হয়তো বা রয়ে গেছে আরেক যোগসূত্র। ভগবান বুদ্ধ ঘর –সংসার ছেড়ে পথে নেমেছিলেন জীবনের বিচিত্রতার সাধনায়। আর আধুনিক যুগে সংসার থেকে বিতাড়িত মায়েরা বৃদ্ধাশ্রমে বাস করে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু- ইত্যাদি নশ্বর জীবনের যাপন কথার অমোঘ বার্তাটি হৃদয়ঙ্গম করেন।এ বার্তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে । বেশ উপভোগ্য ও স্মরণযোগ্য গল্প। শাশ্বতী সরকারের অমরত্বের খোঁজে গল্পের পরতে পরতে সম্পর্কের জটিল বুনন এসেছে সহজ ভাষায় । জীবনে তেমন কিছু না হয়ে ওঠা ভিকি হতাশা থেকে মুক্তি খোঁজে অনর্গল স্বপ্নচারণে, তার অবচেতন মনলোক ধর্ষক বাবার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের উপায় খোঁজে, আকাঙ্খা করে মাতৃজাতির প্রার্থিত সম্মান । এভাবেই সে খুঁজে চলে জীবনের জ্যোতিঃলোকের পথ।

তমালি রায়ের মানুষ হিন্দু-মুসলমানের নিটোল সম্প্রীতির গল্প। এ ধরণের গল্প যত বেশি লেখা হবে, আমাদের জনমানস গোঁড়া ধর্মীয় বাতাবরণ থেকে মুক্ত হয়ে তত বেশি যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠবে।

ঋণী গল্পে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বেশ ঝরঝরে ভাষায় তুলে এনেছেন সম্পর্কের এক ভিন্নতর বাঁক । মানুষের ব্যক্তিগত যাপন চিত্রের কত শত খুঁটিনাটি অস্তিত্বের খোঁজ সব সময় রাখা যায় না, রাখলেও সংশয় থেকেই যায়। এ গল্প এক হারিয়ে যাওয়া জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) পিতা ও আরেক একক মায়ের ছেলের জীবন কথা। পিতা পুত্রের সম্পর্কে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা কিন্তু চিরকালীন মানবীয় আবেগের দাবি কিংবা অন্বয়টি কে অস্বীকার করতে পারেনা। গল্পের এই মর‍্যাল মনে করিয়ে দেয় সাহিত্যচর্চার মহত্তর লক্ষ্য আসলে অফুরান জীবন রসের নিবিষ্ট সাধনা এবং মানব-কল্যানের নব দিগন্ত ।

বাবা–মেয়ের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব-জটিলতা নিয়ে গার্গী রায়চৌধুরীর সম্পর্ক গল্পটি বস্তুত একটি সুদূরপ্রসারী গল্পের অভিমুখ। প্রার্থিত পরিণতির প্রত্যাশা থেকেই যায়। প্রান্তিক মানুষের জীবনে নির্বীজ-করণের মত বাস্তব অথচ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে গল্প খুব কম লেখা হয়েছে। কৃষ্ণা দাসের নির্বীজ গল্পটি সেই হিসেবে বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। শিক্ষিত, সুভদ্র নাগরিক যেখানে নিজের জৈবিক দৈন্যের বিষয়টি এড়িয়ে দাম্পত্য পর্ব টিকেই স্বীকৃতি দিতে অপারগ হয়, অন্ত্যেবাসী, শ্রমজীবি মানুষের চেতনা সেখানে স্বাভাবিক জীবন বোধে অনায়াসে অতিক্রম করে যায়। প্রচলিত সমাজমান্যতার ছক উপেক্ষা করে নিজের পুরুষত্বকে বাজি রাখতে তার দ্বিধাহীনতাকে তখন বাহবা না দিয়ে পারা যায়না।

 গল্প শুনতে শুনতে শ্রোতার আত্মশক্তি যে সপ্রাণ হয়ে ওঠে সোনালির শায়িত বুদ্ধ গল্পটি না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন হত। অসাধারণ কিছু শব্দ বিন্যাস দিয়ে ঘেরা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি উদ্বোধনের গল্পটি বহু কাল মনে থাকবে।

আসরের শেষ পর্বে মহাশ্বেতা রায় শোনালেন ফেলে আসা ছেলেবেলায়, মা ভাই, প্রতিবেশী , বন্ধুদের সান্নিধ্যে ঝুলন সাজানো দিনের স্মৃতি। সেই সব ভাল লাগার উৎসব আধুনিক নাগরিক জীবন থেকে নিছক অবহেলায় হারিয়ে গেছে।মহাশ্বেতা রায় তার অনুপম গদ্যে, প্রায় রূপকথার ভাষায় তুলে আনলেন সেই মহার্ঘ কিছু দিন। আর সেই হারিয়ে যাওয়া ঝুলন উৎসব পালনের আনন্দের রেশ আমরা সবাই সারা অস্তিত্বে মেখে নিলাম। পৌঁছে গেলাম আমাদের অগম্য শৈশবের সোপানে, মনে পড়ে গেল সেই সব দিনের অজস্র অনাবিল সম্পর্কের কথা।



পনেরো জন গদ্যকারের স্বরচিত গল্পপাঠে পঞ্চদশ গল্পবৈঠক নিটোল পূর্ণতা পেল আরো দু’জনের সান্নিধ্যে। নেশা’স কিচেনের পক্ষ থেকে সাহিত্যপ্রেমী দীপা চ্যাটার্জীর আন্তরিক আপ্যায়ন এবং সেদিনের আসরে পঠিত গল্প নিয়ে বিশেষ অতিথি সাহিত্যিক কাবেরী রায় চৌধুরির খোলামেলা, অন্তরঙ্গ আলোচনা ছিল দিনের বাড়তি প্রাপ্তি । শর্তহীন স্নিগ্ধতায় এই দুই নারী গল্প বৈঠকের প্রতিটি সদস্য ও বন্ধুদের মানবিক সম্পর্কে জড়িয়ে নিলেন। গল্পবৈঠকের যাত্রাপথ এগিয়ে চলবে আরো কয়েক শতক আসরের লক্ষ্যে ।


কৃষ্ণা রায়

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

চতুর্দশ গল্পবৈঠক @ মৃত্তিকা


ষাঢ়ের তিন তারিখ হয়ে গেল, না কি চার? অথচ বৃষ্টির দেখা নেই। সমস্ত কলকাতা বাষ্পাকুল কেটলির মত ফুঁসছে শুধু। তারই মধ্যে ত্রিকোণ পার্কের মাড ক্যাফের মৃত্তিকা নামের একটা ঘরের চৌহদ্দিতে, অবশ্যই এসি-র বদান্যতা সহই, চমৎকার বসবার ব্যবস্থা এবং অ্যাকুস্টিকস নিয়ে, জমে উঠল চতুর্দশ গল্পবৈঠক অথবা গবৈ। মাঝামাঝি অথবা শেষের দিকে প্রধান আহবায়ক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বললেন, গবৈ কেন আলাদা। কেননা গবৈ কোন পত্রিকা বার করেনা, ফান্ড রেজিং করে না, গবৈ পুরস্কার ঘোষণাও করে না।সম্মাননা দেয় না কারোকে। এখানে নবীন প্রবীণ সদস্যরা আসেন গল্পকে ভালবেসে। গল্পের টানে। আর কোন স্বার্থ থাকেনা। এভাবেই পথ চলছে গবৈ, একের পর এক অনুষ্ঠানে ভেন্যু থেকে ভেন্যুতে জম্পেশ হয়ে উঠছে সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত আদান প্রদানে, অংশগ্রহণে, বন্ধুতায় । 




সেদিন অর্থাৎ ১৮ই জুন, ২০১৭ শুরু হল অধিবেশন ঠিক বিকেল চারটেতে। মাড কাফে-র তিনতলার মৃত্তিকা ঘরটিতে তখন দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্র সঙ্গীতের হালকা অনুরণন । লাল শানের মেঝে দেওয়া পুরনো বাড়িটিতে একদা থেকে গিয়েছেন জর্জ বিশ্বাস ও শম্ভু মিত্র , তৃপ্তি মিত্র, ভাড়াটিয়া হিসেবে। আজ সারাবাড়ির কোণে কোণে তাঁদের ছবি টাঙানো। প্রাথমিকভাবে গান দিয়ে শুভারম্ভ । বর্ষার গান গাইলেন ডাঃ সুতপা গুপ্ত। 
তারপর গল্প পাঠের সূত্রপাত। প্রথমেই আষাঢ়ের দিনটার নিয়মরক্ষা করা হল একটি দুর্দান্ত ভূতের গল্পের আবহ দিয়ে। কৃষ্ণা দাসের সান্ধ্য সমাপতন। রীতিমত রোমাঞ্চকর এক কাহিনির সূত্রপাত। পটভূমি এক পুরাতন বাড়ি, তার ছাত। সে ছাত থেকে দেখা যায় কাঁসাই নদী। রোমহর্ষক গল্প। পরবর্তী গল্প নিবেদিতা ঘোষ মার্জিতের ভ্যাঁদা। নিবেদিতার বেশ কিছু গল্প শুনেছি আমরা আগের গবৈ তে। তার একটিও আমাদের হতাশ ত করেই নি, উল্টে প্রত্যাশা আরো বাড়িয়ে চলেছে। ভ্যাঁদা গল্পেও ছোট ছোট বাক্যে একটা স্পষ্ট সহজ ছবি পাওয়া গেল, সমাজমনস্ক মানবিক এক গল্পের রেণু লেগে ছিল এই ক্ষুদ্র লেখায়। চাইলে পরবর্তীকালে এ গল্পকে বিস্তারও দেওয়া যায়। এর পরের গল্প ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের “অ্যাক্রোফোবিয়া”। নামকরণেই একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া। খুব ভাল গল্পকারের বৈশিষ্ট্য লেখন ভঙ্গিমায়। অল্প কথায় ঘটনাক্রমের বর্ণনা এবং শেষমেশ উত্তরণ। দুটি অর্থে অ্যাক্রোফোবিয়া শব্দের ব্যঞ্জনাকে ছড়িয়ে দেওয়া। অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া। বিসমিল্লায় গলদ পড়লেন স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়। অ্যাক্রোফোবিয়া গল্প যেমন নাম নিয়ে খেলা করে। স্বপ্নার লেখায় নামটাই গল্পের বড় অংশ। গল্পে কোথাও সরাসরি নামটার সংযুক্তি না থেকেও, গোটা গল্প জুড়ে একটা গলদের ছায়াচ্ছন্নতা ঝেঁপে আসে। অতিবাস্তব কিন্তু অত্যন্ত সংযত সেই বিবরণ। জাম্প কাটে পরিণত। এর পর জয়তীর শেষ উপহার। বাস্তব ঘটনা অনুসরণে লিখিত। একটা দুর্দান্ত প্রেমের গল্পের প্রচন্ড ঝাঁকুনিময় পরিসমাপ্তি। স্তম্ভিত করে। সুলিখিত, সুপঠিত। মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়, ঘটনার বীভৎসতায়। রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্প এই ভারি হয়ে আসা পরিমন্ডলে একটা দারুণ রিলিফ, যেরকম তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েই থাকি। শব্দখেলায় দক্ষ আর রসবোধে অনুপম রজত, সকলের রজতদা রীতিমত নাকানি চোবানি খাইয়েছেন সেই সব স্বঘোষিত শিল্পবোদ্ধাদের যারা শিল্পকে “কিসসু হয়নি' বলে দাগান অথবা অন্য কারুকে ‘কিসসু বোঝেনি' বলে গালি দেন। কাঁদি কাঁদি কলা আর শিল্প কলার সম্পর্ক রজতদা স্পষ্ট বুঝিয়ে ছাড়েন। 
নন্দিনী সেনগুপ্ত এর পর দেখালেন যাদু। তিনি ছিলেন এদিনের অতিথি গল্পকার। প্রথমদিনেই জার্মান গল্পের অনুবাদে “ বোলিং ট্র্যাক / ক্রীড়াভূমি” একটি অসামান্য অভিজ্ঞতা ছিল আজ। অনুবাদ বলে ত মনেই হয়না এত জোরালো বাংলা। ক্ষমতাশালী অনুবাদক নিঃসন্দেহে। আর পড়েছেন অবাক করা এক শ্রুতিনাটকীয় ভঙ্গিমায়। স্যালুট নন্দিনীকে, এই রকম চিরতরে সমকালীন এক বিষয়কে অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের কাছে এনে দেবার জন্য। যুদ্ধের গল্প প্রতিদিনের যুদ্ধদামামার সময়ে অত্যন্ত স্পর্শ করে যায় আমাদের। সুগত চৌধুরীর ক্যাবলা, বেশ চমৎকার একটি কলেজি প্রেমের গল্প। প্রেমের গল্পকে সূক্ষ্মভাবে রসবোধ দিয়ে ধরার ক্ষমতা খুব অল্প লেখকেরই থাকে। এখানে সুখ এবং দুঃখ দুই মিলে মিশে অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য ঘটে উঠেছে। চেনা চেনা মানুষের ছবির সঙ্গে মিলেমিশে যায়। কৃষ্ণা রায়ের মাতৃপর্ব। এক চমৎকার মনস্তাত্বিক কাহিনি। তিন প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধন। মা মেয়ের সম্পর্কের ভেতরে করুণা পর্ব ঈর্ষ্যা পর্ব। নানা পর্বের দোলায়মানতা। স্পর্শযোগ্য। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের পরী। ভিন্ন এক অবস্থান বা দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যে কোন ছোট গল্পই আমাদের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভব আনে। চেনা গল্প তখন অচেনা। গ্রামের মেয়ে পরীর দৃষ্টিকোণের সারল্য, তার বঞ্চনা এবং অ্যাবিউজের অনুভবটি ছুঁতে সাহায্য করে শ্রোতাকে। শাশ্বতী সরকারের অহল্যা নামে একটি গল্প এর পর। প্রেমবুভুক্ষু এক নারীর গল্প। যে নিজে পাথরই থেকে যায়। বার বার চেষ্টায় তার চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়। অথবা যে পুরুষ কে সে কামনা করে অন্য পুরুষের সম্পর্ক মিলেমিশে যায় তার মধ্যে। চৈতালি চট্টোপাধ্যায় এরপর পেশ করেন অপ্রস্তুত নামের অতি ক্ষুদ্র এক অণুগল্প। চমক এবং বিস্ময়ে যে কোন শ্রোতাকে ছুঁতে সক্ষম গল্পটি। একজন মানুষকে সামান্য জেনে তাকে ভুল বোঝার প্রবণতা কতটাই না আমাদের , সেদিকে আঙুল তোলে এ গল্প। এর পর কনিষ্ক ভট্টাচার্য পড়েন অদ্ভুত আঁধার এক নামে একটি বিস্ময়কর লেখা। গল্পটি আমাদের এই সময়কে এমনই এক তীক্ষ্ণ শ্লেষে তুলে ধরে যে কশাহত হয় শ্রোতা। সংখ্যা ছড়িয়ে পড়েছে ঝড়ের অভিঘাতে, সমুদ্রতীরে। এ দৃশ্য হিচকক বা পূর্ব ইউরোপের কোন চিত্রপরিচালকের ছবির সুররিয়াল দৃশ্যের মত আমাদের আচ্ছন্ন করে। সেই সংখ্যা তুলে তুলে শিক্ষক সৈন্য রাজনীতিক সাংবাদিক সকলেই তাঁদের কাজে লাগাতে থাকেন। শেষ যেখানে এসে বাঁক নেয় গল্পটি সেটা সমসাময়িক একটি ঘটনাকে তুলে আনে মনোদেশে। সুস্মেলী দত্ত পড়েন গ্রহণ নামে একটি গল্প। মনস্তাত্বিক গল্প এটিও। নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া এক মেয়ের কথা। গ্রহণ শব্দটির দুই প্রচলিত অর্থই মাথায় আসে। করুণা হয় মূল চরিত্রকে। এবার গার্গী রায়চৌধুরীর আলোর ডায়েরি। ডায়েরি ফর্মে লেখা এক মেয়ের লড়াইয়ের কাহিনি। লেখাপড়া করে নিজের প্রতিষ্ঠা পাবার পথে যে সব সাধারণীদের অনেক বাধা, তেমনই এক মেয়ের উত্তরণের কাহিনি এটা। আশাবাদী। এখানেও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই আলোর উৎস। শেষ গল্প যশোধরা রায়চৌধুরীর “ঐ বাড়িটা”, কিশোরপাঠ্য গল্প। এ গল্পের চরিত্ররা মনুষ্যেতর। শেষ পাতে খানিক হাসির আমেজ। অনুষ্ঠান শেষ হয় অনেক সুখাদ্য ( দার্জিলিং চা ও গ্রিলড স্যান্ডুইচ) সহকারে। একেবারে শেষে আবার গান। 

যশোধরা রায়চৌধুরীর কলমে 
 

মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭

গল্পবৈঠকের বিদেশ সফর- ৫ই মে ২০১৭


 মে মাস, ২০১৭। ফিলাডেলফিয়া পৌঁছানোর আগেই নিউজার্সির তিন লেখকবন্ধুকে কথা দেওয়া ছিল। 
ছেলের কাছে গিয়েই যেন তাদের সঙ্গে একটিবার হলেও দেখা করি। আর বন্ধু মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী তো আগাম নেমন্তন্ন করেই রেখেছিল তার বাড়িতে অন্ততঃ একটিবেলা যেন পাত পেড়ে খেয়ে আসি। ফেসবুকে তার রন্ধনশৈলীর দিব্যি পরিচয় পেয়ে আসছি সুস্বাদু বাহারী সব পদের মনোহরা ছবি দেখে।  তাতেই এদ্দিন গ্যাস্ট্রোনমিক ফূর্তি হত। মৈত্রেয়ী যে সু রাঁধিয়ে তা জানতাম। সে রাঁধে আবার গল্পও বাঁধে নিজের কলমে।  তার গল্প সংকলন বহ্নিশিখাও পড়ে ফেলে তাকে ফিডব্যাক দিয়েছি। তার গদ্য বেশ সরস। প্যাপিরাস ই-পত্রিকায় তার টের আগেই পেয়েছি। আরেকজন হল সুদীপ্তা বুয়া চ্যাটার্জী। সেও একসময় ব্লগ লিখত। প্যাপিরাসেও লিখেছে। মৈত্রেয়ীর পড়শী আরেক সৃষ্টিশীল মেয়ে। প্ল্যান ছিল অনেক কিন্তু ফিলি তে পা দেবার আগেই ফেসবুকে সুদীপ্তার ছেলের হাত ভেঙে যাবার ছবি দেখে সেখানে গিয়ে উতপাত করা বা গল্পবৈঠকে সামিল হওয়া, কোনোটাই মাথায় ছিল না। এই সুদীপ্তা আর মৈত্রেয়ী ফেসবুক আমাদের কলকাতার গল্পবৈঠকে ছবি দেখলেই এতদিন ধরে মনখারাপ করত আর বলত, দিদি, এখানে এলেই কিন্তু গল্পবৈঠক হবে। মনে আছে তো?



আরেকজন বন্ধু হল সংগ্রামী লাহিড়ী। তার সাথে আমার ওঠাবসা বহুদিনের। প্রথমে বেথুন, তারপর সায়েন্স কলেজ আর তারপর আমার কর্তার সহকর্মী ছিল সে প্রাইস ওয়াটার হাউস, কুপার্স, কলকাতায়। সংগ্রামী কোর বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্রী। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট অনুরাগ এবং দখল তার। ফেসবুকে তার আর আমার সাহিত্যচর্চা, নিয়মিত ইন্টারনেট আবাপ তে আমার লেখা পড়ে সে দেশ থেকে জানানো ইত্যাদির ফলে সংগ্রামীর সঙ্গে সে বিদেশবাসী হবার পর লেখালেখির কেমিষ্ট্রিটা জমে উঠছিল। প্যাপিরাসেও লিখেছে সে বার দুয়েক।  এবার ফিলি তে গিয়ে একটু থিতু হয়েই মনে হল, আশেপাশেই এই তিনবন্ধু কে অন্ততঃ জানিয়ে দি ব্যাপারটা, যে আমি এখানে এসেছি। নয়ত ফেসবুকে ছবি সাঁটালে ওদের মন ভার হবে। ওরা বলবে, খেলব না, সংগ্রামী, সুদীপ্তা, মৈত্রেয়ী তিনজনেই বেদম গোঁসা করবে। আরো যেসব বন্ধুরা আমেরিকায় আছে তারা আমার থেকে অনেক অনেক দূরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিন্তু এই তিনজন একদম পাশের স্টেটেই। ইনবক্স করতেই ফোনাফুনি আর তারপরেই চরম উত্তেজনা আমাদের চার বন্ধুর।



- দিদি, তোমরা willow grove স্টেশনে পৌঁছনর মিনিট দশেক আগে একটিবার কল করে দিও রাজর্ষিকে। আনন্দের চোটে সব ভুল হয়ে যাচ্ছে, আচ্ছা, তোমাদের আশাকরি কোনো ফুড অ্যালার্জি নেই, যদি থাকে একটু জানিও...

কি আনন্দ! কি আনন্দ! বিদেশ বিভূঁই তে বাঙালী বন্ধু যেন সহোদরা।

মৈত্রেয়ীই দায়িত্ব নিল। তার বাড়িতেই এক সপ্তাহান্তে গল্পবৈঠক হবে। সেই সঙ্গে ডিনার। 

আগেই বলেছি ফিলাডেলফিয়ার যোগাযোগ ব্যাবস্থার জন্মলগ্নে বৃহষ্পতি তুঙ্গে। বাস, ট্রাম (ট্রলি) এবং লোকাল ট্রেন পরিষেবা একটিমাত্র কোম্পানির অধীনে যার নাম সেপটা (SEPTA) বা সাউথ ইষ্টার্ণ পেনসিলভেনিয়া ট্রান্সপোর্টেশান অথোরিটি । আর তাই বুঝি এত সুসংবদ্ধ এই নেটওয়ার্ক ।  অতএব পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেলাম বেলাবেলি। টিকিট কাটাই ছিল অনলাইনে।  ঘন্টাদুয়েক চলার পর মৈত্রেয়ীর কথামত নেমে পড়ি উইলোগ্রোভ স্টেশনে।  সেখানেই প্ল্যাটফর্মে হাজির ছিলেন বন্ধুপতি রাজর্ষি দা। মুগ্ধ হতে হল আতিথেয়তায়। কত যত্ন করে বেচারি নিজের উইকএন্ড প্ল্যান বাতিল করে শুধু আমার জন্যে  ছুটে এলেন অফিস কাছারি সামলিয়ে।
প্রিন্সটন  মেডোজ এর  প্লেনসবরোতে কার্পেটের মত সবুজ ঘাসে মোড়া জঙ্গলের মধ্যে মৈত্রেয়ীর বাড়ি পৌঁছলাম। কিছপরেই রীতিমত মাঞ্জা দিয়ে মাটন কারীর ঝোলা হাতে সুদীপ্তার প্রবেশ সাউথ ব্রান্সউইক থেকে।আর তার কিছু পরেই পার্সিপেনি থেকে এল সংগ্রামী তার কগনিজেন্টের ব্যাস্ত দায়ভার সামলিয়ে, নিজে হাতে বেক করা কেক নিয়ে।    
তারপরেই চা কফি পর্ব সঙ্গে মৈত্রেয়ীর হাতের বানানো ফিশ পকোড়া, সংগ্রামীর কেক জমে গেল সেই বিকেলে। এবার কথা না বাড়িয়েই গল্প পর্ব। গল্পপাঠ শুরু হল। পাশেই জঙ্গল, পাখির কিচিরমিচির। বাইরে কাঁচের দরজায় ঝোলানো বার্ডফিড এর সুদৃশ্য  খুপরী।  হালকা ঠান্ডার রেশ তখনো। পাখী আসতে বাধ্য। মন উচাটন। ওরে ওরে রোদ থাকতে থাকতে ছবি তোল। ছেলে ছবি তুলছে কখনো পাখীর, কখনো আমাদের গল্পপাঠের।
অতঃপর, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে।
মৈত্রেয়ীর গল্পের নাম "চেরী রঙের ড্রেসার"। পুরোনো ড্রেসার কিনে গুপ্তধন লাভের গল্প, সত্যি ঘটনা অবলম্বনে... মুগ্ধ শ্রোতা, আমার পুত্র শুভায়ন, সুদীপ্তার দুই পুত্র, স্বয়ং শুভ্র আর সায়ন শুভ্র, মৈত্রেয়ীর কন্যা সুকন্যা এবংআমাদের তিনজনের পতিদেবতারা। আর কি চাই? একেবারে ফাঁকা মাঠে গল্প বৈঠক কখনো গোল দেয় না।



এরপর সংগ্রামীর সেদেশের ভারতীয় অভিবাসীদের নিয়ে, এক্কেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প। তারপরে সুদীপ্তার আগের দিন রাতে লেখা গল্প "নির্ভেজাল দিনের আত্মকথন"। আর  সবশেষে আমার অলৌকিক গল্প "চুনীর আংটি এবং থুরা" দিয়ে শেষ হল সেদিনের গল্পের আড্ডা । 

তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়া মৈত্রেয়ির ডাইনিং টেবিলে। রীতিমত সসৈন্যে আক্রমণ যেন। ডাল-ভাত-ফুলকপির ডালনার সঙ্গে ধোঁকার ডানলা, টার্কির বল কারি আর সুদীপ্তার মনোহরা মাটন জমে ক্ষীর সেই মূহুর্তে।

ছেড়ে যেতে মন চায় না তবুও ফিরতেই হল সে রাতে। রাজর্ষি দা আমাদের ছেড়ে দিয়ে গেলেন ফিলি তে। গল্পবৈঠকের টুপিতে আরো একটি পালক যুক্ত হল সেদিন। দেশের গন্ডী পেরিয়ে তার প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখা...বেশ অন্যরকম, খুব আনন্দদায়ক। এটি বিদেশে প্রথম আর সব মিলিয়ে ত্রয়োদশ বৈঠক ছিল।    

বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৭

“গল্প বৈঠক বর্ষবরণ - ১৪২৪”

এই সময়, ২২শে এপ্রিল ২০১৭ শনিবার



২২শে এপ্রিল, ২০১৭, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল শিল্প ও সাহিত্যের এক অনন্য মেলবন্ধন। বেহালা ফাইন আর্টস সোসাইটির পক্ষ থেকে এখানে আয়োজন করা হয়েছে বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনী, ২১শে এপ্রিল থেকে ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ পর্যন্ত। জলরঙ, চারকোল এবং ক্যানভাসের ওপর আক্রিলিক রঙে আঁকা অনিন্দ্য সব চিত্রকলায় প্রাণ পেয়েছে শিল্পী মনের নিভৃত দর্শন। চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে কেবলই মনে হচ্ছিল শিল্প এবং শব্দ যুগপৎ পথ চলতে পারে। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন প্রেমাংশু মিত্র, সমীর কর্মকার, তপন ভট্টাচার্য, গৌতম চৌধুরী, নিলয় কান্তি বিশ্বাস, অপূর্ব মজুমদার, বিশ্বজিত পাল, সঞ্জু মান্না এবং সত্যব্রত কর্মকার।
তাঁদেরই আমন্ত্রনে ২২ শে এপ্রিল বিকেল চারটে থেকে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে আয়োজিত হল “গল্প বৈঠক বর্ষবরণ - ১৪২৪”। শিল্পী বন্ধুদের গল্প বৈঠকের তরফ থেকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ এবং অশেষ কৃতজ্ঞতা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, এক বছর আগে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সেন্ট্রাল গ্যালারিতে, বেহালা ফাইন আর্টস সোসাইটির বন্ধুদের সাহচর্যে ও সহযোগিতায় আয়োজিত হয়েছিল প্রথম গল্প বৈঠক। তাই “বর্ষবরণ” কথাটি এখানে দ্ব্যর্থবোধক, অর্থাৎ, গল্প বৈঠকের এক বছর পূর্তি এবং নতুন বাঙলা বছর ১৪২৪ কে সাদর আবাহন।




 গল্প বৈঠকের থিম সঙ গেয়ে অনুষ্ঠানের সুচনা করলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, জয়া চৌধুরী এবং অয়ন চৌধুরী। গানটির কথা অয়ন চৌধুরীর এবং সুর ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের । এদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ছিলেন ভ্রামণিক, সম্পাদক এবং সাহিত্যিক শ্রী অমরেন্দ্র চক্রবর্তী। তাঁর উপস্থিতি এবং মূল্যবান মতামত গল্প বৈঠককে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করল। তিনি বলেন, লেখকের সাধনা একাকী, অন্তরালে। নিজের গভীরে ডুব দিয়ে তাঁকে খুঁজে আনতে হয় কিছু শব্দ, যা অন্য মানুষদের আলো দেখায়, তাই লেখকের দায়িত্ব অনেক। তাঁর বক্তব্যে তিনি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন মেয়েদের লেখালেখির কথা। তাঁর মতে মেয়েদের লেখার ভাষা এখন অনেক বলিষ্ঠ ও অসঙ্কোচ। তাদের লেখার মধ্যে শোনা যাচ্ছে তাদের নিজেদের লড়াইয়ের গল্প, ফুটে উঠছে তাদের নিজস্ব স্বর, নিজস্ব দৃষ্টি। শ্রী চক্রবর্তী পাঠ করলেন তাঁর নিজের কবিতা “ধর্না” - পরমকল্যাণের পথ চেয়ে অন্তহীন অপেক্ষায় থাকা।


গল্পে, কবিতায় গল্প বৈঠকের আসর জমে উঠেছিল। 

রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের  “নেইবাবুদের গল্প” আসলে সরকারি নেইবাবুদের নিয়ে লেখা একটি পরম উপাদেয় স্যাট্যায়ার। এই  নেইবাবুরা সরকারি খরচে ন্যায্য এবং অন্যায্য সব সুযোগ সুবিধা নেবার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত কিন্তু কাজের কাজ করার বদলে এনারা করে চলেন “নেই কাজ”, অর্থাৎ যে কাজের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, যা কিছু শুধু খাতায় কলমে। লেখাটি আদতে একটি ব্ল্যাক হিউমার যা একটি গভীর সমস্যাকে হাস্যরসের মোড়কে পরিবেশন করে।

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিতের গল্প ন্যুড স্টাডি, একটি অসাধারণ গল্প যার মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি স্তর। ক্লাস সেভেনের একটি ছেলে তার অমলিন দৃষ্টিতে মাকে স্বল্পবসনা অবস্থায় স্নানরত দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার জীবনের প্রথম ন্যুড ছবিটি আঁকে। গল্পটির শেষে এই অপ্রত্যাশিত মোচড়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। কোথাও যেন ফ্রয়েড সাহেবের ইদিপাস কমপ্লেক্স উঁকি মারে।

কস্তূরী চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা “কেমন আছ” একটি অতৃপ্ত ভালবাসার, মন কেমনের মেদুর কবিতা। সোনালির কবিতা “সংসার” আমাদের আটপৌরে জীবনে আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে থাকা ভালবাসার কথা বলে। দিনের শেষে এই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ।

পাপিয়া ভট্টাচার্যের গল্প “অসবর্ণ” গল্পে লেখিকা তার সহজাত সাবলীল ভাষায় নিম্নবিত্ত পরিবারের অশিক্ষিত, সাধারণ অথচ ব্যাতিক্রমি মেয়ে বুলির জীবনচিত্র একেছেন। সমাজ সংসার নির্দেশিত ভালমন্দের ধারণাগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি নিজের অন্তরে যা সত্য বলে অনুভব করে তাকেই অনুসরণ করে জীবনে। মেয়েটি অপ্রেম জানে না। অসুখী হয়েও সে ভালবাসা ঢেলে দিতে জানে। এর মূল্যও তাকে দিতে হয় সারাজীবন ধরে, নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে। তবু শেষ পর্যন্ত কোথাও যেন সে জিতেই যায়। আমরা যারা ব্যক্তিজীবনে নানারকম ভাবে আপোষ করতে করতে বেঁচে থাকি, তারা চমকিত হই মেয়েটির সততা ও চরিত্রের বলিষ্ঠতায়।

শাশ্বতী সরকার পড়লেন চারটি কবিতা। “আহ্বান” কবিতাটি রুপক ধর্মী।  সোনার ফসল ফলাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উষ্ণ মাটি ভালবাসার আহ্বান জানায় মেঘ ও বৃষ্টিকে। ‘সাধ’ কবিতায় পাই ভালবাসাকে ঘিরে অন্তহীন সাধ-স্বপ্নের আখ্যান। “স্বপ্নভুমির খোঁজে” কবিতায় ফুটে উঠেছে বিপন্ন সময়ের অসহায়তা। “অহল্যা” কবিতাটি অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলতে পেরেছে প্রতীক্ষা ও সমর্পণের কাহিনী।

নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লেখা প্রবীণা সাহিত্যিক শ্রীমতী কণা বসু মিশ্রের কবিতা “সত্তরের সেই দশক” ফুটিয়ে তুলেছে অস্থির সময়চিত্র - ছাত্র রাজনীতি, কাঁদানে গ্যাস, পুলিশের গুলি, খণ্ডযুদ্ধ। তবুও কবিতা, তবুও প্রেম বেঁচে থাকে সংগোপনে, বাঁচিয়ে রাখে সভ্যতার সবুজ বাগান।

বরেন্দ্রনাথ দাসের গল্প “বিপন্ন বার্ধক্য” আধুনিক সমাজের নিস্থুর অমানবিকতার ছবি তুলে ধরেছে, যেখানে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যেই স্বার্থপরতার শিকার হয় পরিবারের বয়োবৃদ্ধ মানুষজন।

সুস্মেলী দত্তের “চক্র” কবিতায় প্রেম আসে, প্রেম হারিয়েও যায় ঋতুচক্রের আবর্তনে। তবুও মনের কোণে তার রেশটুকু থেকেই যায়। “যাপন” কবিতাটিও প্রেমের কবিতা। প্রাত্যহিক জীবনের নানা ওঠাপড়া মধ্যেও জেগে থাকে প্রেম। রোজকার দিনগত পাপক্ষয়ে ভালবাসার অপেক্ষায় থাকাই আমাদের সার্থক যাপন।

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের গল্প “মণিডাইনি” এক ভূমিকন্যার অবহেলিত জীবনের কথা, তার স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস, বঞ্চনা, লড়াই, ক্রমাগত ব্যবহৃত হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কাহিনী। নিজের পরিবারের লিঙ্গরাজনীতি তাকে স্বপ্নপুরণের কোনও সুযোগই দেয় না। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হতে হতে সে একসময় ডাইনি বলে ঘোষিত হয়, তাও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। এই পোড়া দেশে এমন অনেক হতভাগ্য মেয়ের প্রতিনিধি হয়ে সে আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা যেন তার দিকে তাকাতে পারি না। কঠোর বাস্তব থেকে আহৃত এই কাহিনী আরও বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠে লেখিকার অনবদ্য পঠনভঙ্গিতে।

তৃষ্ণা বসাকের শক্তিশালী কলম আবার উপহার দিল একটি চমকপ্রদ গল্প “উকুন”। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রোতাকে চমকিত করতে করতে গল্পটি এগিয়ে যায় তার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। কি অনায়াস দক্ষতায় লেখিকা একসূত্রে গেঁথে ফেলেন কিছু আপাত বিচ্ছিন্ন বিষয়। সামান্য উকুন থেকে শুরু করে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সংশয়ের দোলাচলে ঝুলতে থাকা সম্পর্ক, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিজেকে নাঙ্গা করে ফেলার অসহায়তা, সত্য মিথ্যার দন্দ্বে বিপর্যস্ত মানুষের ব্যাক্তি পরিচয় পেরিয়ে গল্পটি পৌঁছে যায় শ্রেণীহীন সমাজের অলীক স্বপ্ন, ভয় বা সম্ভাবনার দিকে।

গল্প বৈঠকের আসরে বিশেষ ভাবে পাওয়া জয়া চৌধুরীর স্প্যানিশ অনুবাদ গল্প “সার্জেন্ট চেও লোপেসের মৃত্যু।” মূল কাহিনী সিরো আলেগ্রি (পেরু)। এক সাধারণ সৈনিকের মৃত্যুর খবরে তার প্রাক্তন সতীর্থ ও সহযোদ্ধার স্মৃতিতে ফিরে আসে যুদ্ধের কটুস্মৃতি, মৃত্যুর সঙ্গে ওঠাবসা করার সাতকাহন। মৃত্যু এ গল্পে একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার নিজস্ব গন্ধ আছে, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের সে সঙ্গ দেয়, পাশে থাকে। শবযাত্রায় সাধারণ সৈনিক টিকে স্যালুট জানানোর ইচ্ছে দিয়ে শেষ হয় গল্প। জয়াকে ধন্যবাদ, বিশ্ব সাহিত্যের এমন সব মণিমাণিক্যগুলিকে বাঙলা ভাষার পাঠকদের কাছে তুলে ধরার জন্য।

পারমিতা মুন্সীর কবিতা “বিবাহ প্রস্তাব” কবিতায় পাই একটি অভিনব বিবাহের প্রস্তাব। যৌথ জীবন, দাম্পত্য যেন একটা খেলা, বা প্রতিযোগিতা, বডি কনট্যাক্ট গেম, হাডুডু বা জুজুৎসুর মত। বিবাহের প্রস্তাব আসলে সেই খেলায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো। প্রস্তাবটিকে লোভনীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে এই কথা বলে যে, এখানে কোনও রেফারি নেই এবং প্রতিপক্ষ স্বেচ্ছায় হেরে যেতে রাজি।

অয়ন চৌধুরীর গল্প “ডিকেসি ১, ডিকেসি ২” কর্পোরেট জগতের এক টুকরো ছবি তুলে ধরেছে। একটু খাপছাড়া, অন্যরকম চিন্তাধারার মানুষ ডিকেসি এই জগতে চূড়ান্ত মিসফিট এবং সকলের উপহাসের পাত্র। এ জগতে ঘোষিত নীতির সঙ্গে মেলে না বাস্তবের নিরীক্ষা। ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে স্বাধীন চিন্তার কোনও মানুষের পা ফেলা মানতে পারেনা কেউ। আধুনিক সমাজমননের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে সেখানেও।

শর্মিষ্ঠা ঘোষের গদ্য কবিতা “কাল্পনিক” তুলে ধরেছে রোজকার জীবনসংগ্রামে বিদ্ধস্ত মানুষটির ফেসবুকে ছদ্ম প্রোফাইলের আড়ালে মুক্তি খোঁজার কাহিনী। গল্পটি খুব চেনা। আমরা সকলেই তো কোনও না কোনও ভাবে এই এসকেপিসম আশ্রয় করে বেঁচে থাকি।

কৃষ্ণা রায়ের গল্প “টান” মানবমনের চিরন্তন টানাপোড়েনের গল্প যেখানে সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনায় উদ্বিগ্ন মাতৃসত্তা মেয়ের কমপ্যাশনেট গ্রাউনডে চাকরি হবে ভেবে স্বামীর মৃত্যুকামনা করতেও পিছপা হয় না। সময় বদলে দেয় সবকিছুই। স্বামীর প্রতি ভালবাসার টান থেকেও অনেক শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায় সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা। কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে গিয়ে একাকার হয়ে যায় সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের বোধ। আশাপূর্ণা দেবীর তীব্র বাস্তবধর্মী গল্পগুলির তিক্ত কষায় স্বাদ স্মৃতিতে ফিরে আসে যেন!

কৃষ্ণা দাসের গল্প “অসুখ” তুলে ধরে এক মনোবিকলনের কাহিনী। আপাতভাবে সুস্থ স্বাভাবিক স্মার্ট ঝকঝকে ছেলেটি টেলিফোনে কথা বলে চলে তার মৃত প্রেমিকার সঙ্গে। আধুনিক জীবনের ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে মনের ওপর চাপ বেড়েছে অনেকগুন। সেই সঙ্গে প্রেমিকার মৃত্যুজনিত ডিপ্রেশন, মেলাঙ্কোলিয়া। ফলে ছেলেটি মনের ভারসাম্য হারায়। অসুখ কি আসলে শুধুই ঐ ছেলেটির?

তমালী রায় পাঠ করলেন তিনটি কবিতা। “ঈর্ষা” কবিতাটি বলে, অন্যের ঈর্ষা অর্জন করতে হলেও যোগ্যতার প্রয়োজন। ঈর্ষা কবিকে আরও দৃঢ় করে তোলে । “প্রহর” কবিতায় পাই, সারাদিনের নানা কাজের ফাঁকে কিছু নির্জন অপার্থিব মুহূর্ত যত্নে তুলে রাখা থাকে ভালবাসার জন্য, যা মনের মেঘ কাটিয়ে নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে দেয়। “আধুনিকতা” কবিতায় বলা হয় আধুনিকতার সঙ্গে সমান্তরালে বয়ে চলা অস্থিরতার কথা।

ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প “কুহক” তুলে ধরে মানবমনের আর এক জটিল গোলকধাঁধার কথা। বিপত্নীক বৃদ্ধ একটি অল্পবয়সী মেয়ের চেহারায় তার মৃতা স্ত্রীর চেহারার কিছু মিল খুঁজে পেয়ে বারবার তাকে দেখতে চাইতেন, মেয়েটির সঙ্গলাভের আশায় নয়, তার স্ত্রীকে ফিরে দেখার বাসনায়। এভাবেই যেন সময়কে হারিয়ে দিয়ে স্ত্রীর মৃত্যুকে অস্বীকার করতে চাইতেন তিনি।

বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প “মৃত্যু”। আত্মসর্বস্ব মানুষ হারিয়ে ফেলছে মানবিকতার বোধ। এমনকি পথেঘাটে কারও মৃত্যু ঘটেছে শুনলেও সে কোনও আগ্রহ বা কৌতূহল বোধ করে না, শুধু নিজের অসুবিধার কথা ভেবে কিছু ক্ষোভ আর বিরক্তি উগরে দেয়। মেট্রো রেলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে গেছে হঠাৎ। যার ফলশ্রুতিতে এই সমস্ত ভাবনা মনে আসে অরুনাংশুর। পরে জানা যায় মৃত ব্যক্তিটি তাঁর নিজের সন্তান। শুধু যে অন্যের প্রতি মানবিক বোধেরই মৃত্যু ঘটেছে তা নয়, আত্মসর্বস্ব জীবনে মানুষ সন্তানের মনের খবর রাখতেও ব্যর্থ, মৃত্যুর করাল ছায়া এতটাই বিস্তৃত আমাদের জীবনে, এমনই একটি ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয় গল্পটি।



    অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সঞ্চারী চক্রবর্তী। তাঁর সুললিত কণ্ঠে দু’কলি রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শেষ হল দ্বাদশ গল্পবৈঠকের আসর।

পরিশেষে আরও একবার উল্লেখ করতে হয় বেহালা ফাইন আর্টস সোসাইটির শিল্পী বন্ধুদের আন্তরিক আতিথেয়তার কথা। গল্প বৈঠকের প্রত্যেক সদস্যকে পুস্পস্তবক দিয়ে অভিবাদন জানানো থেকে শুরু করে ভেজিটেবিল চপ এবং চা দিয়ে আপ্যায়ন। আমরা অভিভূত, আপ্লুত, মুগ্ধ। তাঁদের সকলের জন্য গল্প বৈঠকের তরফ থেকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা। শিল্প সাহিত্যের এই মেলবন্ধন দীর্ঘস্থায়ী হোক, এই কামনা করি।


 ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন

শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭

গল্পবৈঠক একাদশ

শিলাদিত্য পত্রিকার  মে ইস্যু তে গল্প বৈঠক একাদশের কথা 





বার গল্পবৈঠকের একাদশ অধিবেশন হয়ে গেল গত ২৫শে মার্চ, কথাশিল্পী শরতচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত অশ্বিনী দত্ত রোডের বাসভবনে। এবারের গল্পবৈঠকে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছিলেন নবনীতা দেব সেন। অণুগল্প পাঠ করলেন উদীয়মান দশ গল্পকার। ছোটগল্প পড়লেন দুজন। প্রতিটি গল্পের আলোচনায় ছিলেন প্রবীণ গল্পকার কণা বসু মিশ্র এবং এ প্রজন্মের গল্পকার তৃষ্ণা বসাক। গল্পপাঠ শেষে একটি আলোচনা চক্রে অংশ নিলেন চারজন। আলোচনার বিষয় ছিল "ফেসবুকে সাহিত্য"  সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অয়ন চৌধুরী। 
শুরুতে শ্রদ্ধেয়া নবনীতা দেব সেনের সাবলীল আলাপচারিতায় উঠে এল কিছু জরুরী কথা। তাঁর স্নেহের উপদেশ  একটি ছত্রে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র ।
"আমার প্রথম বই বেরোয় ১৯৫৯ সালে। মানে ধরো ষাট বছর হল লেখা শুরু করেছি। আমরা যখন লিখতাম সবাই একা একাই লিখতাম। লেখা পত্রিকার ঠিকানায় পোষ্ট করতাম। আমরা যারা লেখালেখি করতাম চুপিচুপি, কখনও বা বন্ধুকে দেখাতাম। কোনোদিন পকেটে কবিতা নিয়ে বন্ধু চলে আসত। যারা লেখে তাদের সঙ্গে আলাপ হত। আমি কি লিখলাম তুই দ্যাখ, তুই কি লিখলি আমি দেখি। আমাদের একটা জগত ছিল খুব ব্যক্তিগত। আমরা পরস্পরকে ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করতাম। বিশ্বাস করতাম। কোনও সমালোচনা সসম্মানে বিশ্বাস করে গ্রহণ করতাম। আমরা পরস্পরকে সত্য কথা বলতে পারতাম। কোনও অপমানবোধ ছিলনা। কাজেই মতামত দিতে দ্বিধা ছিলনা। লেখা নিয়ে এ ওর বাড়ি চলে যেতাম। কোনোদিন আমি হয়ত তারাপদর বাড়িতে রাতে শুচ্ছি। বলতে পারতাম একে অপরকে – দ্যাখ, এটা হয়নি। এই শব্দটা এই হলে ভালো হত। বা এই লাইনটার বদলে এটা হলে ঠিক হত। সুনীল সারাক্ষণই আমাদের বলেছে, এবং আমরাও বলেছি। প্রথম প্রথম সংকোচ হত। তবে আমাদের ব্যপারটা আলাদা ছিল। গোষ্ঠীবদ্ধ ছিলামনা। আমাদের নিয়মিত বসা, জড়ো হওয়া, একটি ঘর ঠিক করে সেখানে সভাসমিতি ডাকা, কোনও প্রশ্ন উঠছেনা। খুব ব্যক্তিগত ছিল। গভীর গোপন। নিজের একটা লেখা নিজে কাউকে পড়ে শোনাবো, এ আমাদের ভাবনার বাইরে। লিখে ফেলে রাখতে হবে। অনেকদিন পর হয়ত আবার পড়লাম। খাতায় রয়ে গেলো। আবার পড়লাম। এইভাবে আমাদের লেখা হত। নিজের লেখা নিজে পরব এটা আমরা ভাবতে পারিনি। এটা ভীষণ লজ্জার ব্যপার। ওই হয়ত টেবিলের ওপর ভাঁজ করে রাখা কাগজ রেখে বলেছি – পড়। তখন আমাদের ব্যক্তিগত প্রচারের ইচ্ছেটা খুব কম ছিল। প্রচারধর্মী একটা সাহিত্য জগত যেখানে আমার ভয় করে। প্রচারের কথা ভেবে ভয় করে। এত প্রচারধর্মী হলে আমরা ভাববো কখন? আমাদের মুখটা বাইরের দিকে হয়ে যায়। ও কি বলছে, ও কি বলছে, ও কি বলছে। ফেসবুকে এখন লাইক দেয়। আনলাইক বা ডিসলাইক দেওয়ার জায়গা নেই কিন্তু। কেউ কেউ একটা পোষ্ট করে আকুল হয়ে থাকেন। কটা লাইক পড়ল। আমি যত দেখি এই প্রচার ব্যাকুলতা তত আমার বুকটার ভেতরে একটা কষ্ট হয়। আমি সমালোচনা করছিনা। যখন যে যুগ। এখন গল্প উপন্যাসের সময় নেই। এখন অনুগল্পের যুগ। সময়ের সঙ্গে মানাতে হবে। হয়ত এখন যারা লেখেন তারা আরও ভালো লিখতে পারতেন। আরও মনোযোগ দিতে পারতেন। আরও সূক্ষ্মভাবে ভাবা হত। এত বড় দলে পড়া হয়না। আলোচনা হয়না। এ তো সভা! সবাই বলে বাঃ, বেশ!  আমি মনের কথা বলছি আপনাদের। পরস্পরের পিঠ চাপড়ে কোনও সাহিত্য হয়না। আপনাদের মধ্যে যারা যারা সত্যি সত্যি লিখতে চান, তারা নিজের মধ্যে একটু ডুব দিন। বহির্মুখী হলে কখনও কোনও শিল্প চরম সত্যে পৌঁছয়না। যারা অন্তর্মুখী তারা অনুভব করতে পারে। বহির্মুখী হলে আমি যে কতটা দিতে পারি তা বোঝা হয়না। বুঝতে সুযোগ দেয়না আমাদের বন্ধুরা। পাঁচটা কবিতার বই সামনে খুলে পড়ে পড়ে একটা চমৎকার কবিতা লিখে ফেললাম। এটা চলে না। নিজে নিজেকে বলতে হবে। নিজের মানোন্নয়ন খুব জরুরি। আত্মতৃপ্তি থাকলে আমরা বড় জোর দোতলায় উঠতে পারি। কুড়িতলায় ওঠা আর হবেনা। আত্মতৃপ্তি বিষ। সেটা একটা মুহূর্তের। আমি একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে মনে করি যে আমাদের সময় এটা ছিলনা। আমরা খুব সৌভাগ্যশালী। বকুনি খেতাম আবার লিখে আনতাম। এবার ভালো হচ্ছে? হ্যাঁ এবার ভালো হচ্ছে। একটা গভীর আত্মবিশ্বাস থাকলে সমালোচনা গায়ে লাগেনা। যদি কেউ নিন্দে করে সেটাও বুঝতে পাড়া যায়, যে এ নিন্দে করছে, সমালোচনা করছেনা। আজ এ পর্যন্তই থাক। আবার কথা হবে, আলোচনা হবে। ভালো থাকুন সকলে"
এবার আসি গল্প বৈঠক প্রসঙ্গে। 




 গল্পবৈঠক সমমনস্ক কিছু লেখকদের একটি বৈঠক যেখানে পরস্পরের গল্প পাঠ ও আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের দুর্বল ও সবল জায়গাগুলো উপলব্ধিতে আসে। এবং অগ্রজ সাহিত্যিকদের পরামর্শে নিজেকে আরও কিভাবে উন্নত করা যায় সেই নির্দেশও ধারণা হয়। একে ঠিক সভা সমিতি বলা চলেনা। এখানে কোনও পুরষ্কার প্রদান হয়না। হয়না কোনও পত্রিকা প্রকাশ বা বই সংকলন।  আমাদের শ্রদ্ধেয় শ্রীমতী কণা বসুমিশ্র ছিলেন আলোচকের ভুমিকায়। তাঁর সহকারী ছিলেন তৃষ্ণা বসাক।  গল্পের  আলোচনায় আসি। পারমিতা মুন্সীর গল্পে পলাশ চরিত্রটি মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের শিকার। কল্পিত চিঠি ও চিঠির প্রত্যুত্তরে গল্পের উন্মচন। শেষ পরিণতিতে সমাজের নানা প্রতিকুলতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার কষ্ট স্পষ্ট হয়। তমালি রায় পরিবেশন করলেন দুই সমকামী যুবকের একজনের রূপান্তরকরণ ও বিয়েতে পরিণতি। সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এ এক ইচ্ছাপূরণের গল্প। শ্বাশ্বতী সরকারের গল্পে এক নারীর আত্মসংলাপ। সারাটা জীবন যেখানে অসুস্থতা ও মৃত্যু ছায়া ফ্যালে। দূরত্ব বাড়ায় আত্মজনের সঙ্গে। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের গল্পে অপরাজিতা দেবী যদি সত্যিই মেলের উত্তরটি দিতেন তবে মনে এক আশা জাগত। আহা যদি সত্যিই এমন হত! বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে মৃত্যুতেই একটি প্রেমের আভাস রয়ে গেলো। যে রয়ে গেলো তার মনে চিরকালীন এক অনুভূতি থেকে গেলো। কৃষ্ণা দাসের গল্পে দিদিমাকে নাতনির উপহার একটি মোবাইল। যার সুত্রে বৃদ্ধ বয়সে দিদিমার এক বৃদ্ধ বন্ধু হলেন। বয়সকালের একাকিত্বে মোবাইলের ইতিবাচক ভূমিকাটি সকলেই পছন্দ করলেন। রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প এপ্রিল ফুল। একে গল্প না বলে রম্যরচনা বলা চলে যা নিজগুনে মনোহরণ করে। জয়া চৌধুরী মুলত হিস্পানিক সাহিত্যের অনুবাদের কাজ করেন। তাঁর পঠিত গল্পটি অদ্ভুত তীব্র তরঙ্গ সৃষ্টি করে মনে। তাকে ধন্যবাদ এইসব সৃষ্টিকে তুলে ধরার জন্য। মহুয়া মল্লিকের গল্পে সাম্প্রতিক এক দুর্ঘটনার ছায়া। সে বড় কষ্টের। সেই কষ্ট থেকেও এক মহৎ অনুভব জাগে। ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে পরকীয়ার আকর্ষণ থেকে ফিরে আসা একটি মেয়ের কথা। নিত্যদিনের হরেক দায়িত্বের সঙ্গে জড়ানো মায়া। ভারী সুন্দর। যশোধরা রায়চৌধুরীর গল্পে এক অসুস্থ মানুষের কথা। যিনি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হাসপাতালে। স্মৃতি হাতড়ে মনে করছেন কিছু। একটি শুকনো লঙ্কার অনুসঙ্গে ফিরে এলো স্মৃতি। অসুস্থ মানুষটির ও লেখকেরও। অতনুপ্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প জন্মান্তর। মাছ হয়ে যদি জন্মাই! কিন্তু ফিরে আসতে কি সত্যিই ইচ্ছে করে? বিশেষত সত্যিটা যখন এমন দুঃখের।

শ্রোতার আসনে ছিলেন গল্পবৈঠকের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, অগ্রজা গল্পকার, ঔপন্যাসিক পাপিয়া ভট্টাচার্য। 

এমনই নানা গল্পের সম্ভারে জমজমাট হয়ে গেলো সেদিনের বৈঠক। আগামী বৈঠকের প্রতীক্ষায় তাই। 
  



প্রতিবেদনঃ অনিন্দিতা মন্ডল  

বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

ফেসবুক কি সাহিত্যের ক্ষতি করছে?


ফেসবুক কি সাহিত্যের ক্ষতি করছে? 

কেন বলুন তো এসব নিয়ে ভাবছি আমরা? আমরা যারা সাহিত্যকর্মী, ভাবনাটাই আমাদের একমাত্র সম্বল আর সেই মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনাচিন্তাগুলোকে কলমের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত করাটাই আমাদের কাজ। ফেসবুক হল মত প্রকাশের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। সকলে কি আর প্রিন্ট পত্রপত্রিকার দয়া দাক্ষিণ্যে মত প্রচার করতে পারে? সেই আম জনতার স্বাধীন মতপ্রকাশের মুক্তাঙ্গন হল ফেসবুক। ফেসবুক আসার আগে বহু মানুষ কিন্তু নিজেদের ডায়েরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন। ফেসবুক তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। বহু মানুষ তাদের লেখা পড়ে মতামত দিচ্ছে, তাদের লেখা শেয়ার করছে। ফলে লেখাকের পরিচিতি বাড়ছে। এবার আসি কোর সাহিত্যচর্চা বা কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি প্রসঙ্গে। ফেসবুকে অনেকেই কবিতা, ছড়া, অণুগল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস লেখেন। সেগুলি কিন্তু লেখকের নিজস্ব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি। সেই লেখা কিন্তু চুরি হয়েছে, বহুবার দেখেছি। সেই লেখা ফেসবুক থেকে কপি পেস্ট হয়ে ব‌ই সংকলনে বেরিয়েছে তাও দেখেছি। সেটাই বোধহয় নিন্দনীয়। তবে ফেসবুকের মাধ্যমে একজন লেখক যে পরিচিতি পান একছাদের নীচে, বহু মানুষের সামনে সেটা কিন্তু খুব সত্যি কথা। ফেসবুক আছে বলে নতুন সাহিত্যসৃষ্টি হচ্ছে। সাহিত্যের ক্ষতি হচ্ছে, এ কথা আমি মানতে নারাজ। সাধারণ মানুষের কাছে ফেসবুক মানেই ইন্টারনেট। সেটাই দুঃখের। ফেসবুক ছাড়াও যে ইন্টারনেট দুনিয়ার একটা বিশাল ব্যাপ্তি আছে সেটাই আমরা জানিনা বা বুঝিনা। আর ফেসবুক সাহিত্যের ক্ষতি করলেই বা কি, না করলেই বা কি? আমরা যারা লেখালেখি করি ইন্টারনেটের হাত ধরে যেমন ফেসবুকে, ব্লগে , ওয়েব পত্রিকায় লিখি তেমনি লিখে যাব। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। 


এই নিয়ে আলোচনায় থাকছেন অনেকেই ২৪, অশ্বিনী দত্ত রোডে, শরতচন্দ্রের বাসভবনে।(উপরের কার্ডে বিশদ দ্রষ্টব্য)
আর আপনিও আপনার মতামত জানাতে পারেন, ফেসবুকে এবং এই ব্লগপোষ্ট এ ।
২০০ শব্দের মধ্যে লেখা উত্কৃষ্ট মতামতগুলি প্রকাশিত হবে প্যাপিরাস পয়লা বৈশাখ ২০১৭ সংখ্যায়। আর হ্যাঁ, ব্লগে কমেন্টের সাথে আপনার ছোট্ট পরিচিতি দিতে ভুলবেন না।

রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বসন্তের গল্পবৈঠক


রাজারহাটের ইকোট্যুরিজম পার্ক। চার নম্বর গেটের ডান দিকেই  "Leaves n Aroma"-র চা-ঠেক-এ মিতালী, সমীর এঁদের কবোষ্ণ আতিথেয়তায় রচিত কিংবা খচিত হল গল্পবৈঠকের এক বসন্ত বিকেল, গত বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি,২০১৭। 
নানা রঙের বসন্ত।কালো।হলুদ।লাল।ধবধবে সাদা।এটা ছিল গল্পবৈঠকের ছোট-গল্পপাঠ অনুষ্ঠান।দশম অধিবেশন।শুরুতে জয়া চৌধুরীর স্তোত্রপাঠ,সারাক্ষণ রন্ধনে অপরিহার্য নুনের মতো ছড়ানো ছিটোনো রসিক মন্তব্য,টুকরো স্প্যানিশ গান ও মঙ্গলকাব্যের মনসাপালা এবং কথনে জয়ার সঞ্চালনাটি হয়ে উঠেছিল অপরূপ!প্রথমে চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের গল্প।মাতৃশক্তিকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ স্বেচ্ছায় আদর করে মর্যাদা দেবে না,তা মেয়েদেরই অর্জন করে নিতে হবে,এই-ই ছিল গল্পের বিষয়।তারপর নিবেদিতা ঘোষ মার্জিতের নিবেদন আমোদিনী পর্ব।কী হিমশীতলতা! ফুরোল গা- চমকানো অলৌকিকতায়!কিন্তু বহুক্ষণ কনকন করল এক মর্মান্তিক বাক্য: শহরকে আমোদিনী বুঝিতে পারে না...।যশোধরা রায়চৌধুরীর,অ্যাজ ইউজুয়াল,মধ্যবিত্ত দাম্পত্য বিবরণ,যা হাঙ্গরের দাঁতের মতো মসৃণভাবে রক্তপাত ঘটায়,টের পেতে সময় লাগে!ছেলের বউয়ের কাছ থেকে সংসার টেনে নিয়ে নিজের তাকে তুলে-রাখা এক শাশুড়ির গল্প,যাঁকে ঘৃণা করার জন্য নাক কুঁচকোতে গিয়েও সজল হয়ে এল মন! এরপর শ্রুতিনাটক।কস্তুরী চট্টোপাধ্যায় ও সুস্মেলী দত্ত-র ছিমছাম পরিবেশনায় স্বরচিত নাটক 'প্রসঙ্গ নারী'।বৈদিক যুগের জিভ-কেটে-নেওয়া খনা আজও কত প্রাসঙ্গিক সেটাই তুলে ধরলেন ওঁরা।এবার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের মেটামরফোসিস।শুনতে শুনতে কাফকা পেরিয়ে মার্কোয়েজের যাদু বাস্তবতা মনে পড়ছিল। মঞ্জু তামাং সমাজের চাপে একটু একটু করে ডাইনি হয়ে ওঠে।ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেয় পুরুষ আগ্রাসনের!বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের 'গল্পপাঠ'। বরিষ্ঠ দীপ্তিদির আর ডাক পড়ে না সাহিত্যসভায়।তিনি ডেটেড! কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপডেটেড কে,আর,কতটুকু!আপেক্ষিক তো সবই! শেষে ঝাঁকুনিটুকু চমৎকার।এবার শাশ্বতী সরকার।গল্পের নাম 'ছেঁড়া তার'।মেনোপজ-হয়ে-যাওয়া তন্বী নিত্য নতুনভাবে বসন্ত পেতে চায়। পারে না।কারণ,তার ছিঁড়ে গেছে কবে...! গার্গী রায়চৌধুরীর মেয়েলি উপন্যাস ১,স্বামীর মৃত্যুর পর,যে স্বামী ছাড়া আর জানত না কিছুই,সে কেমন নিজস্ব আইডেন্টিটি নিয়ে জেগে উঠল ধীরে ধীরে!পাপিয়া ভট্টাচার্যের গল্প আলোকলতা,তাঁর কণ্ঠবৈকল্যের কারণে আমাদের শুনতে না পাওয়ার অতৃপ্তি রয়ে গেল।সোনালি পড়লেন তাঁর মনস্তাত্বিক গল্প 'শব্দ'। শুধু মাথার মধ্যে শব্দ-ঘেরা-জগৎ,তার যন্ত্রণা,অস্বস্তি সবকিছু নিয়ে। 

নিজেদের কাজকর্ম ফেলে উইকডে তেও হাজির হয়েছিলেন যারা মানে তমালি রায়,পারমিতা মুন্সি,রীণা গিরি তাঁদের ওইদিন গল্পবৈঠকের প্রদোষে কবিতাপাঠ করতে আমন্ত্রণ জানানো হল ।স্মার্ট।প্রাসঙ্গিক স্ব কবিতা । আর হিডকোর চেয়ারপার্সন দেবাশিস সেন ভারী সুন্দর এক বক্তব্যে ধন্যবাদ জানালেন সবাইকে।আবার আসার আমন্ত্রণও দিলেন।হলুদ পাখির পালক হয়ে উড়ে বেড়াল বসন্তের এই গল্পবৈঠকের বিকেল পেরোনো সন্ধেবেলা। অনুষ্ঠান শেষ হল গল্প বৈঠকের জন্য রচিত নতুন থিম  সং গেয়ে। সমবেত এই গানটির রচয়িতা অয়ন চৌধুরী এবং সুরারোপ করেছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। 
প্রতিবেদনটি লিখছেন চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
 


 ত্যি সত্যি বসন্ত এসে গেছিল। অন্যমাত্রায়, অন্যভাবে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বসন্তের মহিমা নতুন করে উপলব্ধ হল গতকালের এক গোধূলির গোলাপী বিকেলে। হ্যাঁ, রেড ডট। না, না আমিষ নয় কিছুই। সংখ্যাগরিষ্ঠ আমরাই। তাই লাল। গোলাপী নয় তবুও মেয়েলী এক বিকেল।রঙ্গীন বিকেল।  মায়াময় বিকেল। মাটির চায়ের পেয়ালার উষ্ণ অভ্যর্থণার বিকেল আর এই মহানগরের গল্পকারদের নিজস্ব এক বিকেল। আমরা কেমন করে যেন আসছি, দেখছি, পড়ছি আর জয় করছি মানুষের মন । আমরা কেমন এক ঘোরলাগা বন্ধুতায় জড়িয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে।  আমাদের শিকড় এক। আমাদের ভাষা এক। আগের দিন ই ছিল ভাষা দিবস। তাই এ যেন আমাদের সকলের  প্রিয় মাতৃভাষার জন্য মরিয়া হয়ে কিছু করে দেখানও বটে । আমরা বাংলাভাষায় কত রকমের ভিন্নস্বাদের গল্প লিখছি আজকাল। আমাদের নিজেদের বাচনভঙ্গীমায় কত স্বকীয়তা। লেখায় মৌলিকতা, নিজস্বতা। লিখছি লিখছি আর লিখেই চলেছি আমরা। কিন্তু? কে দেবে এই লেখকের স্বীকৃতি? কে দেবে পুরষ্কার? কে নিত্যনতুন গল্প প্রকাশ করে আমাদের সৃষ্টিশীলতার বাহবা দেবে? তাই বলে আমরা কি থেমে থাকব? শৈবালদামের মত বদ্ধ ন‌ই তো আমরা । আমাদের এই পথচলাতেই আনন্দ। আমন্ত্রণ পেয়ে অভিভূত হয়েছিলাম আমরা, যেদিন ফেসবুক থেকে দেখে ইকোপার্কের মিতালী আমাদের তার চায়ের ব্যুটিক "লিভ্‌স এন্ড এরোম্যায়" গল্পবৈঠক এর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । আপ্লুত হয়েছিলাম তখন। কথায় বলে "যেচে মান আর কেঁদে সোহাগ"। কিন্তু আমাদের তো দুটোই পাওয়া হল। না চাইতেই, না ঘ্যান ঘ্যান কারতেই । সত্যি সত্যি শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের গল্পবৈঠক যেভাবে সাড়া ফেলছে তাতে মনে হয় এই সাহিত্যসভাও আমাদের গল্প প্রকাশের একটি অতীব সুস্বাদু মাধ্যম হয়ে উঠছে। ফাগুনের বসন্ত গতকালের বিকেলে নতুন করে ধরা দিয়ে গেল যেন। কেবল মনে হচ্ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই গানের লাইনটি..."আমরা এমনি এসে ভেসে যাই, আলোর মতন, হাসির মতন, কুসুম গন্ধ রাশির মতন, হাওয়ার মতন, নেশার মতন, ঢেউয়ের মতন এসে যাই.."...হ্যাঁ, যাই ই তো। এ ভেসে যাওয়ায় এক অমলিন, অপার আনন্দ। এক অদ্ভুত মাদকতা। নতুন নতুন বন্ধুরা আসছে গল্প শুনতে, তাদের আসা ও ভালোলাগা কে কুর্ণিশ জানিয়ে তাদের কবিতা পাঠেরো সুযোগ দিতে ইচ্ছে হয় ঠিক তখনি। আর এবারের গল্পবৈঠকের দশম অধিবেশনে বিশাল প্রাপ্তি হিডকো'র চেয়ারম্যান শ্রী দেবাশীষ সেনের আমাদের গল্প শুনতে আসা এবং আতিথ্য গ্রহণ করে কিছু বক্তব্য রাখা। এমনো হয়? এ যেন গল্পবৈঠকের শুভ পথচলার আরেক শুভ ক্ষণ। অনুষ্ঠান শেষ হল আমাদের গল্পবৈঠকের সমবেত থিম সং পরিবেশন করে। যে গানের কথা আমাদের অয়ন চৌধুরীর আর সুরারোপ আমার। না থাকুক মুঠো মুঠো পলাশ। না থাক আবীর গুলাল। আমরা কিন্তু অনেক রং নিয়ে ঘরে ফিরেছি সকলে। 
প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৭

শীতকালীন গল্প বৈঠক - ৩

ভাষা কথা বলে, লেখক নয়। এমনটাই মনে হচ্ছিল ২৭ জানুয়ারি গল্পবৈঠকের গল্পপাঠ শুনতে শুনতে। এবারের নবম গল্পবৈঠক বসেছিল কলকাতা বইমেলায় কারিগরের স্টলে। কারিগর এবং গল্প বৈঠকের যৌথ আয়োজন ছিল সেদিন। প্রকাশনার জগতে কারিগর একটি শৈল্পিক নাম। দৃষ্টিনন্দন স্টলে, দেওয়াল জোড়া বই বৈঠকের সঠিক আবহ রচনা করেছিল, সঙ্গে ছিল কারিগরের কর্ণধার দেবাশিস সাউ দম্পতির আন্তরিক আতিথ্য এবং বৈঠকের কাণ্ডারী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ার বৈঠা বাওয়া ।

 পাঠে ছিলেন  চোদ্দ জন গল্পকার,  যাঁরা কেউ নিজের একটি ভাষা খুঁজে পেয়েছেন,  কেউ বা এখনো সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে পঠিত প্রতিটি গল্পই শরীরে  ধরতে চেয়েছে সময়ের চিহ্ন ।  কস্তুরী চট্ট্যোপাধ্যায়ের 'অসমাপ্ত' গল্পে বাবার ইচ্ছের হাত ধরেছিল দেবী। সোনালীর গল্প 'ও জিসাস' ধর্ম আর কামনাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দেখায়। সুষ্মেলী দত্তের 'রোদ' প্রকৃতির রূপকে নারী পুরুষের বৈষম্যকে তুলে ধরে । শাশ্বতী সরকারের 'বিষাদের ঘরবাড়ি'-র শ্রীর আর্তনাদ না উল্লাস বোঝা যায় না। ভাস্বতী ব্যানার্জির 'ডুবোপাহাড়' ইঙ্গিত দেয় আসন্ন বিস্ফোরণের । কৃষ্ণা রায় তাঁর 'বিষাদযাত্রা'য় মৃত ফোয়ারার সামনে বসে জলের জন্য এক অন্তহীন প্রতীক্ষার আশ্চর্য ছবি আঁকেন।সীমিত শব্দে বুবুন চট্ট্যোপাধ্যায়ের 'ফেসবুক ফ্রেন্ড' গল্পে ভার্চুয়াল জগতের ছুঁতে না পারার যন্ত্রণা বুকে মুচড়ে ওঠে । মহুয়া মল্লিকের 'ফুল ফুটুক না ফুটুক ' শ্রোতাকে ধাক্কা মেরে ফেলে ডার্ক ফ্যান্টাসির রহস্যঘন জগতে । এর ঠিক বিপ্রতীপে চৈতালি চট্যোপাধ্যায়ের 'কান্না আর না ' যেখানে ফিল-গুড আবহে বিপন্ন শৈশব খুঁজে পায় উষ্ণ আশ্রয়। দিন আর রাতের পৃথিবীর রূপ যে কত আলাদা তার প্রায় পরাবাস্তব আখ্যান গার্গী রায়চৌধুরীর 'রোষ'। সেখান থেকে রূঢ় বাস্তবে আছড়ে ফেলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় তাঁর 'পাগলী' গল্পে। সিলভিনা ওকাম্পোর স্প্যানিশ গল্পের স্বকৃত বাংলা তর্জমা ' কাঁচে লেপ্টে থাকা মুন্ডু ' পাঠ করে আবারো মুগ্ধ করলেন অনুবাদক  জয়া চৌধুরী । তৃষ্ণা বসাকের 'আনবাটনড' অক্ষয়কুমারকে কেন্দ্র করে এই সময়কে বোতাম খুলে দেখায় আর পরিশেষে যশোধরা রায়চৌধুরীর 'সিরিয়াল ' গল্পের চাপা সন্ত্রাস আমাদের আচমকা শ্বাসরোধ করে । জীবন বেশি লম্বা না সিরিয়াল?

এর মধ্যেই হৈহৈ করে শ্রীযুক্ত পবিত্র সরকারের হাতে উদ্বোধন হল গার্গী রায়চৌধুরীর সংগ্রহযোগ্য গল্পগ্রন্থ যার প্রকাশক কারিগর । বিশেষ অতিথি কবি, গল্পকারএবং নাট্য নির্দেশক আশিস গিরির গল্পপাঠ এবং সুপরিচিত সঞ্চালক রিনির বক্তব্য এই মনোরম বিকেলের উপরি পাওনা ।

সমগ্র অনুষ্ঠানটি চমৎকার  সঞ্চালনা করলেন সুদর্শনা সঞ্চারী চক্রবর্তী । শুরুতে ছিল তাঁর গান। আর চৈতালিদির গান সেদিন যে শুনতে পেল না সে যে কী হারাল,  ভাগ্যিস জানে না !

তবে এরপরও কথা থাকে । গল্পপাঠের শেষে টাটকা আলোচনা হলে গল্পবৈঠকের উদ্দেশ্য সার্থকতর হত।
তৃষ্ণা বসাক   

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৭

শীতকালীন গল্প বৈঠক (২)


২১ জানুয়ারি র উদাসীন চাতাল। স্থানঃ রবীন্দ্র সরোবর, লেকের মাঠ। 

সেদিন দুপুরে, না বারবেলা নয়, লেবু চা আর ঝালমুড়ি র গন্ধে জাফরি কাটা রোদ ছিল।আর সেই রোদের ভেতরে ছিলাম আমরা। আমাদের বন্ধুরা। ২১ শে জানুয়ারি দুপুর ১ টা। আমরা যারা লেখালেখি করি, অনেক পারা, না-পারা সরিয়ে লিখতে চাই, লেখা শুনতে চাই সেই গল্প বৈঠকের বন্ধু রা জড়ো হয়েছিলাম শীতের মিঠে রোদ্দুর ডানায় নিয়ে। লেকের মাঠে, এক উদাসীন চাতালে। সেই চাতালে সঞ্চারী চক্রবর্তী র গান দিয়ে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান।


 


এদিনের অনুষ্ঠানে প্রথমেই গল্প পড়লেন গার্গী রায়চৌধুরী। খুব বেশিদিন নয়, কিন্তু এরই মধ্যে গার্গী র লেখায় স্বাতন্ত্র্য বলে ভবিষ্যতে আর ও ভাল গল্প দেবেন পাঠক কে গার্গী। "ঘাতক" গল্পে গার্গী তুলে ধরেছে একধরনের ফ্রয়েডীয় অবচেতন। পরের গল্পকার অধম। বিচ্ছেদকাতর দম্পতি র সন্তান ছোট্ট মেয়ে টুপুর যে তার বাবা-মা র থেকে ডিভোর্স চায়। কিন্তু পায় কি? তাই আমার গল্পের নাম ছিল। " যদি হত!" পরবর্তী গল্পকার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। সোশ্যাল মিডিয়া কোন জাদুতে সব বদলে দিচ্ছে এক একটি পরিবার তার ই টুকরো টুকরো আভাষ দিলেন ইন্দিরা তাঁর "কৌরব পক্ষ বদলে পান্ডব পক্ষ"গল্পে। ইন্দিরা র কলমের রসবোধ পাঠক অনেকদিন মনে রাখবেন।

এবারের গল্পকার ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়। উদীয়মান চিত্র পরিচালক অনিন্দ্য র সামনে কিভাবে বদলে গেল মেয়েটার দৃষ্টি তাই শোনালেন ভাস্বতী তাঁর " তিলোত্তমা " গল্পে। ভাস্বতী র গল্পে অনেক ধুসর রঙের পরত থাকে সিরিয়াস পাঠকের জন্য!
পাঠক! মাঝখানে চা-মুড়ি- নলেন গুড়ের সন্দেশের নরম সরম কিন্তু চলছেই।
এর ই মধ্যে পায়ে পায়ে হাজির হয়েছেন কোলকাতার মেয়র পারিষদ দম্পতি।



 দেবাশিষ কুমার এবং দেবযানী কুমার। যাবতীয় পারিষদীয় ঝঞ্ঝাট সামলেও ওরাঁ দুজনে এমন মনোরম শ্রুতিনাটক ( নাটকের নামঃ কলকাতার কপালকুণ্ডলা, রচনা বনানী মুখোপাধ্যায় )  করেন কে জানত! এসেছিলেন গল্পবৈঠকের আমন্ত্রনে। আমাদের আর ও একটু উজ্জীবিত করতে। এসেছিলেন গল্প শোনার লোভে সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও। পাঠশেষে খুব জরুরি কিছু টিপস দিলেন সঙ্গীতা। মনে রাখব সঙ্গীতা।


এবার এলেন রজত দা। মানে আমাদের রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর "বদলে গেল হজমল" এ পেলাম আবারো সেই অনায়াস উইট। সঞ্জীব চাটুজ্যের উত্তরাধিকার তাঁর কলমে বললে অত্যুক্তি হবে না।
এদিনের গল্প পাঠের বিষয় ছিল বদল। সমাজ-সংসার-মননে সেই বদলে যাওয়া র ছবি নানান দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছিলেন গল্পকার রা। তেমন ই কৃষ্ণা রায় তাঁর "রাহাজানি" গল্পে বললেন, দুই প্রৌঢ় -র অর্ধেক স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রনার কথা। মন ভার হয়ে উঠল। তারপরেই দীপান্বিতা রায়ের " অর্কিডের টব" পাঠক মন অবশেষে মেদুর হল প্রিয়তোষের মন বদলে। "জুঁইফুল ১৫" গল্পে সাহিত্যিক কণা বসু মিশ্র র কলমের সেই চিরাচরিত যাদু আবার ফিরে পেলেন পাঠক। পরিচিত গল্পকার মহুয়া মল্লিক এদিন আমাদের শোনালেন তাঁর "শামুক" গল্পে প্রিয়তোষের মেটামরফসিস এর কথা।


পাঠক অধৈর্য হবেন না। বদল। এমন একটি বিষয় ভাবনা নিয়ে এক গুচ্ছ গল্পকার সেদিন সত্যিই রামধনুর পরতে পরতে ছুঁয়ে থাকা কত রঙ যে আবিষ্কার করলেন। আসলে সেদিন শীতের জাফরি কাটা রোদের প্রতিটি খোপে খোপে বসে ছিলেন এক-একজন স্ফুলিঙ্গ। তার ই আভাষ দিচ্ছিলেন তাঁরা। একে একে। যেমন - কস্তুরী চট্টোপাধ্যায় কি দৃপ্ত ভঙ্গিতে শোনালেন তাঁর "দ্বিতীয় বাস" গল্পে মধ্যরাতে চারুর একা একা পথ হাঁটার কথা। তেমন ই সাবলীল গদ্যে পুর্বা মুখোপাধ্যায় বললেন, তাঁর " কথায় কথায় বদল" গল্পে দাম্পত্যের মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের কথা। পাশাপাশি শর্মিষ্ঠা ঘোষ বুনে দিলেন অন্য ভাবনা। সেই বোকা মেয়েটির মাথায় হাত রাখতে চেয়েছিল তানিয়া তাঁর "অপত্য" গল্পে। শাশ্বতী সরকার বললেন তাঁর স্বাদু গদ্যে "একলা পথিক" অনন্ত উত্তরণের পথে বদলে যাওয়ার গল্প। সোনালি পেশায় চিকিৎসক বলেই বোধহয় মানুষ কে দেখেন জীবনের নানা মাত্রিক দিয়ে। তাঁর গল্পেও পেলাম সেই স্বাদ। পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝেও ছিল এক " অন্য জগৎ"। এবার এলেন সদাহাস্যময়ী নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত। নিবেদিতার গল্পের শরীরে আশ্চর্য এক বুনন থাকে। আবার ও প্রমাণ করল" বাসাংসি জির্নানি"।


অতুনু প্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিত গল্পকার। তিনি কী মমতায় শোনালেন সুন্দরবনের এক গ্রামের ছেলের বদলে যাওয়ার গল্প " কানাই-চরিত"। টুপাই এর বদলে যাওয়ার গল্প কে অন্য আঙ্গিকে বদলে দিলেন অয়ন চৌধুরী "দুই বদল " গল্পে। এবার এলেন অনুবাদক জয়া চৌধুরী। শোনালেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্পের অনুবাদ "দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ডুবন্ত মানুষ"।জয়া র অনুবাদে সবসময় ই এক সহজাত দেশীয়করণের গন্ধ থাকে। যা পাঠক কে আটকে রাখে তাঁর অনুবাদে। এদিনের গল্প পাঠের অনুষ্ঠানের শেষ স্ফুলিঙ্গ ছিলেন তৃষ্ণা বসাক। " তেলেনাপোতা " গল্পে তিনি শোনালেন ইয়াকুব মামাদের হারিয়ে যাওয়ার কথা। তৃষ্ণার গল্পে সেই স্যাটায়ার আর ও একবার পাঠক কে ভাবতে বসাল।
শীতের রোদে পিঠ ঠেকিয়ে সেদিন সেই চাতালে এমন দাউ দাউ আগুনের কিন্তু সলতে পাকিয়ে যাচ্ছিলেন পৃত্থীশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সহৃদয় উদ্যোগ এবং শিল্পী নিলয় বিশ্বাস এর গল্প বৈঠক এর চমৎকার ব্যানার ছাড়া থোড়ি আগুন জ্বলত!

সবশেষে আরো একবার বলি সেই সঞ্চালক, ফোটোগ্রাফার, সোশ্যালমিডিয়া এক্সপার্টের কথা তিনি হলেন আমাদের বন্ধু অয়ন চৌধুরী। যাঁর একটান অনর্গল সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং একটুও ছন্দপতন না ঘটিয়ে অনুষ্ঠানের হাল ধরে রাখা সত্যি প্রশংসার দাবী রাখে।  

প্রতিবেদনঃ বুবুন চট্টোপাধ্যায়