সোমবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৯

রূপোয় মোড়া গল্পবৈঠক ২৫

অ্যাদ্দিনে তো জেনেই গেছেন, ‘গল্পবৈঠক’ কী, কেন, কাদের। যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য আরেকবার পুরনো পড়া ঝালিয়ে দেওয়ার মতো করেই বলি, এই বৈঠক গল্পকারদের এবং এই দল অধিকাংশই মেয়েমানুষের। আমন্ত্রিত পুরুষ থাকেন বৈকি, কখনও শ্রোতা হয়ে, কখনও লেখক পরিচয়ে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, যে কোনও বয়সের নারী-গল্পকার এই দলে আসেন, আসছেন, আসবেন। মঞ্চ-মাইক-আলো-পুরস্কারের দেখনদারি এড়িয়ে সহযোদ্ধা অক্ষরশ্রমিকের বৃত্ত ক্রমশ বড় হয়েছে। সাহিত্যিক শ্রীমতী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের মনের ছাঁদে গড়া এই মুক্তমনের আঙিনায় আমাদের অনেকের যাতায়াত। আমিও এই দলে সম্প্রতি ঠাঁই পেয়েছি। এবং পাওয়া ইস্তক চেটেপুটে নিচ্ছি খোলা আকাশ। যাঁরা নিন্দেমন্দ করে বলেন, মেয়েমানুষ মানেই কূটকচালি আর কুঁদুলেপনা, তাঁদের জন্য একছড়া কাঁচকলা আর একঝুড়ি বাতিল ছেঁড়া কাগজের টুকরো উপহার রইল। ঐ ঝুড়িতে আমাদের কাটাছেঁড়া করা বাতিল গল্পের শব্দগুলো রয়েছে... ওগুলো হিংসুটে দুষ্টু লোকেদের জন্য।
    ২০১৯-এর জানুয়ারি; দেখতে দেখতে পঁচিশতম গল্পবৈঠক। রজতজয়ন্তী বলে কথা! সাহিত্যিক শ্রীমতী কণা বসু মিশ্রের ফার্ন রোডের ঐতিহাসিক বাড়িতে জম্পেশ ভোজের সঙ্গে জমে উঠল গল্পবৈঠক। এবার থিম ছিল ‘পিকনিক’। শীতের মরসুমে এর চেয়ে চমৎকার থিম আবার হয় নাকি! ছ’শো শব্দের বাঁধন আর সেইসঙ্গে এগারোজনের গল্পপাঠ। আহা! যেমন গল্প, তেমন সব উপস্থাপনা! তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা সাহিত্যিক শ্রীমতী সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ। এমন বিশ্লেষণ আর কাটাছেঁড়া করে ভুল শুধরে উৎসাহ দেওয়ার আশায় সমস্ত জীবন ধরে গল্প লিখে যাওয়া যায়!
    পন্ডিতিয়ার আর সি মাইতি’র দোকানের সিঙ্গাড়া বাড়তি অ্যাড্রিনালিন জোগান দেয় বলেই ইন্দিরাদি সিঙ্গাড়ার ঠোঙা আগে বাড়িয়ে ধরেন সকলের মুখের কাছে। ব্যস! উপচে পড়ে লাবণ্যে মোড়া এক-একটি মণিমুক্তো। শ্রীমতী সুতপা গুপ্ত গেয়ে ওঠেন “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে”; ফার্ন রোডের বাড়ির হাওয়ায় তখন পিকনিকের গন্ধ। 
    জ্যোৎস্নারাতের গানের শেষেই শ্রীমতী জ্যোৎস্না কর্মকার শুরু করলেন তাঁর ‘পিকনিক প্রলেপ’। পাখি-মিমি-স্যান্টির গল্প। এই সময়ের গল্প। আজকের জেন-ওয়াইয়ের প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েন আর ফোবিয়া নিয়ে একটি নিটোল গল্প। যদিও গল্পের ওঠাপড়া নিয়ে সর্বাণীদির পরামর্শ রইল। চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের কলমে কবিতা আর গদ্যের রঙের অপূর্ব মিশেল। তাঁর ‘দৈব-অদৈবের পিকনিক’ গল্পে যদু-রাজীব-অপালা-শমিত-মিমি এই পাঁচটি চরিত্রের মধ্যে তিনজন আত্মকথনে বলে যায় তাদের মনের কথা। বিষবৃক্ষের বীজের মতো গল্পের শেষে জ্যাক ড্যানিয়েলের বোতলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে পরকীয়া আর প্রতিহিংসা।  সাবলীল লেখনী তাঁর। টানটান গল্পটি থেকে মন সরানো যায় না। স্টেটমেন্টের পাশাপাশি ডায়ালগ থাকলে বোধহয় আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে পারত। সে স্বাধীনতা একান্তই লেখিকার।   


    শ্রীমতী স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েন ‘লাল গাড়ির যাত্রীরা’। ষোলজনের পিকনিকে এল পারফেক্ট পিকনিক মেনুর বর্ণনা। অনিমেষ-বাসব-মনোজ-তৃষ্ণা-মেঘা সকলে মিলে পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে অনুভব করে এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা মেলে না। এককথায় ভূতের গল্প। দিব্যি। যদিও বাস্তব আর অলৌকিকের মধ্যে কোনও বিভাজন না থাকায় পাঠক একটু ধন্দে পড়তে পারেন।
কৃষ্ণা রায় শোনালেন ‘অরণ্যশীর্ষে সন্ধে’। পঁচাত্তর পেরোনো বাবা-মা নিজেদের এখন ছেলে পুপুর সংসারে শুকনো লতার মতো পরগাছা ভাবেন, সারাদিন বদ্ধ ঘরে তাঁদের স্মৃতিচারণ, ভারাক্রান্ত করে তোলে চারপাশের পরিবেশ। মফস্বল স্কুলের হেডমাস্টার এখন অবসরপ্রাপ্ত, বৃদ্ধ। তাঁর সঙ্গে এক বিষণ্ণ ডিসকোর্স তাঁর স্ত্রীয়ের। যেমন হয়, যেমন হচ্ছে চারপাশে। প্রায় একই চলনে শ্রীমতী সংযুক্তা সেনগুপ্ত শোনান ‘বিষাদসন্ধ্যা’। বিপ্লব সিকদারের স্মরণসভায় শাপলা-শালুকের পুকুরে ঢ্যালা ছুঁড়ে একটু একটু স্মৃতিবিন্দু তৈরি করেন, প্রবাসী খোকনের প্রিয় খাবার সরিয়ে রেখে পিকনিকে বসে ফিরে তাকান চড়ুইভাতির দিকে। গল্পের শেষে মনের মধ্যে কেমন চিনচিনে ব্যথা। পূর্বা মুখোপাধ্যায় ওরফে মুকুজ্যে গিন্নি যেন কৌটো থেকে অন্য কৌটোতে ঢালা-উপুড় করার মত নিখুঁত জার্ক অ্যান্ড মিক্স দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর লেখা ‘প্রেম অ্যাট দ্য রেট পিকনিক’। নিক্সের জীবনে কাব্যকলি থেকে ম্যাডোনা--  এক আশ্চর্য হালফিল প্রেমের জার্নি। অনেক উপচারের মধ্যেও একদলা নীল কষ্ট বুকের মধ্যে জমাট বেঁধে বসে থাকে। ঝরঝরে লেখনী, আর একটু গভীরে গেলেই চলকে পড়বে গাঢ় নীল রঙের যন্ত্রণা।  
সাহিত্যিক শ্রীমতী কণা বসু মিশ্রর অভিজ্ঞ লেখনী বড় কাব্যময়। ডোরাকাটা পাথরের নুড়ি নিয়ে টুকি খেলা কিশোর আর রাইকিশোরী দূরবীণ দিয়ে দেখে, তাদের পিকনিকের লুকোচুরি খেলা এখন স্মৃতির পাতায়। তারপরেই ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় গড়চুমুকে নিয়ে যান পাঠকদের। পিকনিকের চরিত্র, আলসেমি, ফূর্তি ভরপুর। তূণীরের অফিসের পিকনিকে দূরে আর এক দলের মধ্যে ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকা রাকা। রাকা-তূণীর, রাকা-কৌশিক--  প্রাক্তন প্রেমিক তূণীর আর স্বামী কৌশিক, দু’জনের জীবনেই অপয়া রাকা। ‘আলোড়ন’ গল্পটির শেষে রাকার মনের কথা শুনতে পায় শুধু নদীর জল। একটা লাইনের মধ্যেই অন্য গল্পের মোচড়।  
নন্দিনী সেনগুপ্ত’র ‘সোনা তরঙ্গ নদীধারে’ গল্পটি শুনতে শুনতে মনে হয় যেন নাটক শুনছি। প্রবাসে বরফ ঢাকা প্রান্তরের সামনে এক বসন্তের খোঁজ। রূপক গল্পটিতে শুধুই আসা-যাওয়ার হাতছানি। স্মৃতি আর ব্যথাভরা বেদনার ভার। প্রতিদিনের প্রবাস-যাপনে স্মৃতিভ্রংশ স্থবির এক মানুষকে জাগাতে চায় আরেকজন। বৃষ্টির ফোঁটা ফেলার মতো স্মৃতি ঝরে পড়ে টুপ্টাপ। কাব্যিক, বাস্তব গল্পে বুঁদ হয়ে থাকি অনেকক্ষণ। সোনালী মুখার্জির অসাধারণ বর্ণনায় আধুনিক জীবনের ঝকঝকে বর্ণনা। তার আড়ালে দাঁত-নখ বের করে হঠাৎ হানা দেয় এক সাঙ্ঘাতিক মোচড়। ‘চড়ুইভাতি’ গল্পের শেষের বুনোট বেশ জোরালো ধাক্কা।
আর শ্যামলী আচার্যর গল্পের নাম ‘পিকনিক’। রতু আর শুন্টি কাজ করে বাজির কারখানায়। এই দুটি শিশুশ্রমিক জানে না ‘পিকনিক’ কী, পিকনিক জায়গাটা ঠিক কোথায়, কি কি হয় সেখানে। তাদের স্বপ্ন, কল্পনা, বাস্তব-অবাস্তবের ছায়াপথ এই গল্পে।
সুতপা’র মনভরানো গান আর কণাদির কবজি ডুবিয়ে খাওয়ানোর আয়োজনে দিশেহারা লাগে। ‘গল্পবৈঠক’ শেষ হয়। রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। ঠিক যেমন ‘পিকনিক’-এর স্মৃতি জেগে থাকে দীর্ঘ সময়। সবশেষে মধুরেণ সমাপয়েত সোনালীর আনা গল্পবৈঠকের ২৫ টি অনুষ্ঠান পূর্তিতে আনা কেক দিয়ে। 



প্রতিবেদন লিখেছেন
শ্যামলী আচার্য