মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৯

গল্প বৈঠক -৩৫ @ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, এপিজে বাংলা সাহিত্য উৎসব ২০১৯

শুরুতে ছিল কিছু দরকারি কথা। 







তারপর শুরু হল নবরত্নের অণুগল্প পাঠ 



[তপশ্রী পাল অনিবার্য কারণবশতঃ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তাঁর অণুগল্পটি রইল এখানে। আলোচনাও রইল]
ভিক্ষে
তপশ্রী পাল
থিয়েটার রোডের মোড়ে নেমে প্রতিদিন অফিসের দিকে হেঁটে যায় প্রমিতা । রোজই এসি মার্কেটের সামনে তাকে প্রায় ঘিরে ধরে কৌটো হাতে ভিখিরির দল । কালো জোব্বা পরা চুল দাড়িওয়ালা লোকেরা আর শত তালিমারা পোশাকে মহিলারা। মুখের সামনে কৌটো ঝাঁকাতে থাকে যতক্ষণ না কিছু পায়। কোনরকমে দু চার টাকা দিয়ে পার পায় প্রমিতা । কোন কারণে আজ দলটা নেই । খুশী মনে এগিয়ে যাচ্ছিলো প্রমিতা । হঠাত ওড়নার প্রান্তে টান পড়ায় ফিরে তাকায়। উলঙ্গ কঙ্কালসার একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা একদৃষ্টে তাকিয়ে । এরা এইটুকু বাচ্চাকেও ভিক্ষের ট্রেনিং দিচ্ছে এই বয়স থেকে! দু টাকার একটা কয়েন বার করেও থমকে যায় প্রমিতা । ও কি কয়েনের মানে বোঝে? হয় তো মুখেই ঢুকিয়ে দেবে। কি দেওয়া যায় এই শিশুকে? শেষে ব্যাগ থেকে এক টুকরো ক্যাডবেরী বার করে ওর হাতে গুঁজে দিয়ে প্রায় পালিয়ে যায় প্রমিতা। কিন্তু সত্যি কি পালানো যায়?

কালুভূত আর বুড়ি
নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত
কালু ভেবেছিল গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তেই সমস্যা শেষ।  যখন ভূত হয়ে তার জন্ম হল দেখে চারপাশে ভূত আর ভূত। মরে গিয়ে তো আরও ঝামেলা ।এভাবে যে ভুতের ঘাড়ে ভূত আটকে থাকে মানুষেরা জানে না!  নিজের দড়ির খাটিয়া ছিল। এভাবে থাকা তার বিরক্তিকর লাগল। যতই ভূত হোক কিন্তু ‘আমিবোধ’টা আছে। যাইহোক প্রচুর খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল আরামদায়ক এক বুড়ির ঘর ।সারাদিন টিভি চলে। গোটা চল্লিস ভূত আছে। বুড়ির পাশে বসে কালু দিব্য আনন্দে সিরিয়াল দেখে । মুস্কিল হল সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা করবে তেমন কেউ নেই। বুড়ি বোধহীন। সবুজ বাগান” সিরিয়াল দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলল কালু।ওমা একি! বুড়ি পিঠে হাত বুলিয়ে বলল ,“কাঁদে না।পয়সা পায় তাই অতো কষ্ট আর কান্নাকাটি ।”  আরও একটা ভুতের জন্ম হল।

কবি ও কবিতা
শ্যামলী আচার্য
জানালার শার্সিতে কাঁচা রোদের ফালি। কবি নিস্তব্ধ। গত রাতের না-লেখা কবিতা আলতো হাসে।
হোয়াটসয়্যাপে ঝাঁপিয়ে কেউ-- নতুন কী লিখলেন?
ফেসবুকে ফিতে কাটছেন তরুণ কবি। বইয়ের উদ্বোধনে নায়িকা যোগ হলে বাণিজ্য সম্পূর্ণ হয়। 
এলোমেলো আঁচড় সময়সারণিতে। কবিতা, না-কবিতা, প্রায়-কবিতা। 
মেসেঞ্জারে দুঁদে প্রকাশক। মোটামুটি আশি হাজার ধরে রাখুন। কবিতার চেয়েও জরুরি কবিতার পাবলিসিটি।
অচেনা মহিলার বন্ধুপ্রস্তাব। কেউ বৃষ্টিভেজা দিন, কেউ শরতশেষের রোদ্দুর।
লিটল ম্যাগাজিনের আবদার, এবার গুচ্ছ দেবেন।   
লেখক দলছুট। এত বাজনায় তাঁর প্রার্থিত শব্দ ধরা দেয় না কলমের মুঠোয়। চৌকির তলার অন্ধকারে শব্দের ভিড়।
ধুলো রাস্তায় কবি আনমনা।
ট্রামলাইনে চুপচাপ শুইয়ে দেন অসমাপ্ত ধূসর পাণ্ডুলিপি। চিলের ডানায় রোদ মুছে যায়। ভর করে মৃত্যুর গন্ধ।
কবিতা কবির হাত ধরে। শক্ত মুঠো। ছাড়ানো যায় না।

অউদিপাউসের মা
কৃষ্ণা রায়
বছর কয়েক আগে ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে মা বলেছিল, আজকাল কি সব আধখেচড়া  কুচিকুচি অণুগল্প লেখে।  আয়েশ করে চেটেপুটে না পড়লে হয়?
ঊননব্বইএর মা এখন আর বই পড়েন না, পৃথিবীটা তাঁর  বড্ড এলোমেলো।   চাকরির সময় বাদে সর্বক্ষণ তাই  মায়ের পাশে পাশে। দাদা-দিদিরা হাসে, “সেই মায়ের  আঁচল- ধরা  ছোটছেলে-ই,  রয়ে গেলি” ! মা ছাড়া আমার  একলা জীবনে থাকে কি? শখ- আহ্লাদ ভুলে মায়ের ঘোলাটে জগতে আমি তাই   রাখাল ছেলের  মত  এ-মাঠে—ও- মাঠে ছুটে বেড়াই।   ইদানীং তার বড্ড মেজাজ। দুরারোগ্য স্নায়বিক ব্যাধিতে ভুগছে। আজ অনেকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে স্বস্তি পেলাম।
মাঝরাতে প্রবল আশ্লেষে গলা জড়িয়ে কে যেন বলল, ওগো শুনছো ! কতদিন  আদর করোনা,  তুমিতো আগে  এমন ---, বিছানায় জরতী মায়ের তীব্র চাহনি, গাঢ মায়ায়-লজ্জায় জলভরা  চোখে অন্যদিকে তাকালাম---
স্মৃতিহারা মা ! আলঝাইমার্স আক্রান্ত জীবন পেরোতে পেরোতে  এইমাত্র কয়েকটি শব্দ উচ্চারণে  নিজেই কখন  একটি  করুণ অণুগল্প তৈরি করে ফেলেছেন।
ছোবল 
ব্রততী সেন রায়
উপাচার সাজানো হয়ে গেছে।প্রস্তুতি সম্পন্ন।কণিকার সালোয়ারটা টেনে খুলে নিয়েছে।কামিজ ছেঁড়া,অন্তর্বাস মাটিতে লুটোচ্ছে।সামনে তিনটি উলঙ্গ গোখরা ফণা দোলাচ্ছে।ছোবল মারা শুধু এক পলকের অপেক্ষা।তাদের তিন জোড়া চোখ উন্মত্ততায় লেহন করছে কণিকার অষ্টাদশী উদ্ভিন্ন যৌবন।ঠোঁটের দু পাশ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে।প্রথম বিষধর ঠোঁটের কোণার লালাটুকু চেটে কণিকার দিকে এগোতেই কণিকা কোমল স্বরে বলল,' আমি এইচ আই ভি পজেটিভ।আমার শরীরে কিন্তু এইডস আছে! ' একটা ঝটকা!
বাবা আর জি করে ভর্তি।প্রতিদিনই বাবাকে হাসপাতালে দেখে বাড়ি আসতে রাত হয়ে যায় কণিকার।আর আজ তো স্টেশনে নামতেই তুমুল বৃষ্টি।শর্টকাট রাস্তা ধরতেই সামনে এসে দাঁড়াল এক দল নরপশু।হাত ধরে নিয়ে আছড়ে ফেলল আধ ভাঙা পোড়ো বাড়িটিতে।ওদের ব্লকে কাজ করতে আসা এন জি ও-র মণিমালা দিদিমণির কথাটা মনে পড়ে গেল কণিকার.... আসন্ন বিপর্যয়ের মুহূর্তে।বিদ্যুৎ চমকের মত।
গোখরারা নত হয়ে গর্ত খুঁজে নিল।
ভাগাভাগি
নন্দিনী সেনগুপ্ত
দ্যাখ ছোড়দি, রাঙ্গাদি তুইও দ্যাখ একটু, মায়ের গয়নাগাঁটি বেশিটাই ভেঙে তোদের দুজনের বিয়েতে দেওয়া হয়েছিল। বাকি টুকটাক সব,  দেখে নে একবার... মায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সব নাতিনাতনিরা যাতে  একটা অন্তত চিহ্ন পায়, তাই’... বলতে থাকে বিজন... ‘কিন্তু ছোড়দি,  তুই তো রিয়াকে নিয়ে এলিনা! এই জড়োয়ার ঝুমকোফুলটা রিয়ার জন্য!’     
বনানী চোখ তুলে তাকায়। চোখ দুটো চকচক করে; হাসছে না কাঁদছে?   
‘রিয়ার পরীক্ষা চলছে’, বলে বনানী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর টেনে টেনে বলে, ‘ভাইয়া, এগুলোই স-অ-ব?’   
বিজন উত্তেজিত কণ্ঠস্বর একপর্দা চড়ে... ‘মানে? সব? কী বোঝাতে চাইছিস?  কিছু আমি লুকিয়ে রেখেছি  বলতে চাস?’
বনানী হাসে... ‘ভাইয়া, এই দ্যাখ মায়ের সেলাইয়ের বাক্সে... কতরকম কুরুশের ফুলের নকশা, মায়ের নিজের হাতের তৈরি,  আমি এইগুলো নিচ্ছি,  ফুলগুলো আমার আর রিয়ার। জড়োয়ার ঝুমকোফুলটা নাহয় তুই বৌমণির জন্য রাখ, প্লিজ!’
ঘাট
সোনালি
চটপট গংগামাটি দিয়ে মসৃণ একখানা বেদী বানিয়ে  ফেলে হারু। তার মধ্যে আঙুল দিয়ে জল আর পিন্ড দেবার ফুটো সারি সারি ।
ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মীনা ভাবে কি নিপুন ভাবে  করছে। সকাল থেকে কত মানুষের  পিন্ডদান হল।
মা পাশে এসে বসতেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল মীনা।
" সোনুটা চলেই গেল?  কোথায় ও বড়দের কাজ করবে, তা না আজ ওর কাজ করতে এসেছি?   ছেলের মা হয়ে কি লাভ হল বল?   শুধুই কষ্ট শুধুই ক্ষতি ---
হারু তোয়ালে দিয়ে নিপুণ হাতে জায়গা মুছতে মুছতে ভাবে, " লাভ হল তো।
এই যে বাচ্ছার প্যান জামাগুলি গংগার পারে দিয়ে যাচ্ছ, পরে বাঁচবে আমার ছোট্ট ছেলেটা।
কাজের পয়সা দিতে ত দরদাম করে  গলা ফাটাবে ---
দাও দাও, ছেলের নামেই দাও।

কুয়াশারা আসে যায় আধখান চাঁদ যখন বাণিজ্যতরী
অশ্রুজিৎ

স্বর্ণরেখা পেশায় একজন আর্কিওলজিস্টটি।
জন্ম পড়াশোনা সব লন্ডনে হলেও এই মুহূর্তে তাঁর কর্মক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন বন্দর নগরী চন্দ্রকেতুগড়ে।
এই নদী বন্দরটির সাথেই যে কি ভাবে রোমানদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিলো; সেটাই স্বর্ণরেখার রিসার্চের মুল বিষয়।
এই ব্যাপারে তাঁকে সহযোগিতা করছেন গৌতমবাবু । যাঁর অবদান আঞ্চলিক ইতিহাস সংরক্ষণে অনস্বীকার্য।
একদিন সন্ধেবেলায় পদ্মা নামের এখানকার প্রাচীন মরা গাঙে স্বর্ণরেখা একা ঘুরতে যায়,
তখন আকাশের গায়ে আধখান চাঁদ এমন ভাবে হেলে, ঠিক যেনো একটা বাণিজ্যতরী নোঙর ফেলেছে, নভেম্বরের শেষ দিন তাই খানিকটা কুয়াশাময় এদিকটা।
নদীর দিকে তাকাতেই  স্বর্ণরেখা হঠাৎ দেখতে পেলো, নদীতে একটা ভেলায় ভাসছে কারুর মৃতদেহ আর সেই মৃতদেহ আগলে রেখেছে একটি গ্রাম্য রমণী।
স্বর্ণরেখা শুনেছিলো বটে, ভারতবর্ষের এসব দিকে অনেক গরিব গ্রামবাসী মৃতদেহ দাহ সৎকার করতে পারেনা আর্থিক অভাবে, তাই জলে ভাসিয়ে দেওয়াই রীতি; কিন্তু তাহলেও বউটি কেন ওই মৃতদেহের সাথে ? তাহলে কি সহমরণ এর মতো নির্মম প্রথা এখনো চলছে এই গ্রাম বাংলায়? ভাবতেই শিহরিত হলো স্বর্ণরেখা ।
কিন্তু তাঁকে আরো অবাক করে দিয়ে একটা বিশালাকার লোক হাঁটু জলে নেবে মেয়েটিকে ধরতে এগিয়ে এলো; একটা মেয়ে হয়ে নিজের চোখের সামনে এমন একটা ঘটনা কি করে ঘটতে দেখতে পারে?
তাই নিজের জীবন বিপন্ন করে নদীর পাড়ের খাড়াই বেয়ে নীচে নামতে লাগলো সে; আর ঠিক তক্ষুণি একটা কুয়াশার হাল্লা আবরণ এসে সব দৃশ্যপট মুহূর্তে মুছে দিলো।

গৌতমবাবুর মুখে পরে শুনেছিলো এক অদ্ভুত জনশ্রুতি;
বেহুলা নাকি তাঁর মৃত স্বামীর লাশ নিয়ে এই নদীপথেই স্বর্গে পৌঁছেছিলো, আর ঠিক ওখানেই, তাঁর সাথে সংঘাত হয় গোদা নামের এক দস্যুর; সেই থেকে ওই জায়গা আজও গোদার মোড় নামেই পরিচিত।
অটোবায়োগ্রাফি
শান্তনু ভট্টাচার্য
তিন হাজার বছর আগে এই পৃথিবীতে এসে আমি ছবি এঁকেছিলাম। সেই কুৎসিত অপরাধে আমার শিরচ্ছেদ হয়। এর এক হাজার বছর পরে পৃথিবীতে এসে আমি কবিতা লিখেছিলাম। সেই ভয়ঙ্কর অপরাধে বর্শা খিঁচে দেওয়া হয় আমার বুকে। এর পাঁচশ বছর পরে পৃথিবীতে এসে আমি গান গেয়েছিলাম। সেই ঘৃণ্য অপরাধে বিষপান করানো হয়েছিল আমাকে। এর হাজার বছর পরে পৃথিবীতে এসে আমি সহস্র মানুষকে খুন করলাম। আমার সাহসকে সম্মান জানিয়ে আমাকে বীরের মর্যাদা দেওয়া হল। আমি অমরত্ব প্রাপ্ত হলাম। আমাকে আর পৃথিবী থেকে ফিরে যেতে হয়নি।
আমি ও.. 
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
একমাত্র মেয়ের মানসিক ভারসাম্য হারানোর খবরে অস্থির শ্রীপর্ণা।  মুম্বাই পৌঁছে মেয়ের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখে ওষুধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা,হাতে ধরা ডায়রী - পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা মি টু মি টু।বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারল বয়স্ক বসের অবাঞ্ছিত স্পর্শ আর ভয় দেখানো সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে মেয়ে।কষ্টে,রাগে দিকবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে শ্রীপর্ণা পৌঁছাল বসের রুমে।বস্ পিছন ফিরে ফোনে মগ্ন, শ্রীপর্ণা ছুড়বে বলে  পেপার ওয়েট  ধরা মাত্রই সামনে ফিরল সে। ভিতরে কাঁপুনি , শক্ত হাতে  শ্রীপর্ণা চেয়ারটা ধরল। চোখের সামনে মায়ের ঘরের বাঁধানো ছবিটা - বাবা?
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্রীপর্ণা বলল -  আমি শেষ দেখে ছাড়বো।

সবশেষে অণুগল্পের আলোচনায় 
তৃষ্ণা বসাক
শ্যামলী আচার্য তাঁর ‘কবি ও কবিতা’ অণুগল্পে এই পণ্যায়িত সময়ে, সোশ্যাল মিডিয়ার অশ্লীল কোলাহল থেকে দূরে  কবিকে শুধু কবিতার কাছে থাকতে হয়, দলছুট হতে হয়। তাই বুঝি আজো প্রকৃত কবির প্রার্থনায় থাকে একটি ঘাতক ট্রামলাইন, রোদ মোছা মৃত্যুর গন্ধ। অসাধারণ একটি গল্প। কিন্তু  গল্পটি কেন একজন নারী কবিকে নিয়ে হল না? যাঁর ফেসবুকে জমা হত অচেনা পুরুষের বন্ধুপ্রস্তাব, তাঁর একা, দলছুট কবিতাযাপনে আরও অন্যমাত্রিক বাধা আসত?
কৃষ্ণা রায়ের ‘অউদিপাউসের মা’ যেন গ্রিক ট্রাজেডির সেই অউদিপায়সের কাহিনীর আড়ালে লেখক আলো ফেলতে চেয়েছেন মানুষের মনের এক গহন ছায়াচ্ছন্ন এলাকায়। অ্যালজাইমার আক্রান্ত মা আর সঙ্গীহীন ছেলে- তাদের মধ্যে সম্পর্কের আভাসে আঁতকে ওঠে সভ্য মানুষ, কিন্তু ওই যে মায়া শব্দটি! ওর মধ্যে লেখক এমন একটি ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। এখানেই গল্পটি অসামান্য হয়ে উঠল।
শান্তনু ভট্টাচার্যর ‘অটোবায়োগ্রাফি’ গল্পটির জন্য প্রথমেই তাঁকে ধন্যবাদ। বিরাশি শব্দের মধ্যে একটি চিরকালীন বিষয়কে ধরার জন্য।সভ্যতার আদিকাল থেকেই ছবি আঁকা, গান গাওয়া বা কবিতা লেখা অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতার মুক্তচিন্তাকে শাসক ভয় পায়, তাই তার শাস্তি মৃত্যু। কিন্তু খুন করা একটি পুরস্কারযোগ্য কাজ। খুনী এ সমাজে অমর বীরের মর্যাদা পায়। শান্তনুর গল্পটির মধ্যে পেলাম ফেবলের সুবাস।
নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত এর ‘কালুভূত আর বুড়ি’ স্যাটায়ারের ভঙ্গিতে লেখা উপভোগ্য একটি গল্প। ভূত যেন মানুষের অল্টার ইগো।  ভূতেদের জগতেও খুব ভিড়, তারাও সিরিয়াল দেখে, তাদেরো আমি বোধ থাকে। তবে এই গল্পটির আর একটু জায়গা লাগত। তাতে করে আমরা হয়তো ভূষুন্ডির মাঠ রিভিজিটেড পেতে পারতাম।
নন্দিনী সেনগুপ্তর অণুগল্প ‘ভাগাভাগি’।এই সময়ে এমন মানুষও থাকে যারা জড়োয়ার ফুল রেখে মায়ের সেলাইবাক্সের কুরুশের ফুল নিতে চায়। কারণ জড়োয়ার থেকেও অমূল্য স্মৃতি। খুব মিস্টি, ব্যথার মত একটি গল্প, ফিলিগ্রির কাজ যেন।
 তপশ্রী পাল এর  ‘ভিক্ষে’ অত্যন্ত চেনা বাস্তবের এক গল্প। আমরা যারা নিত্য শহরের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটি, তাদের  অস্বস্তি তুলে ধরেছেন তপশ্রী। আমরা জানি ভিখিরি তৈরি করা হয়, যার প্রতি করুণায় আমরা কিছু দিতে চাই, তার পেছনে থাকা চক্র কেড়ে নেয় সেটুকুও। তবু আমরা দিই নিজেদের বিবেকের দৃষ্টি থেকে পালাতে। কিন্তু সত্যিই কি পালানো যায়? এমন জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন লেখক।
অশ্রুজিত বসু - ‘কুয়াশারা আসে যায় আধখান চাঁদ যখন বাণিজ্যতরী’। অশ্রুজিতের গল্পের নামটা যেমন বড়, তেমনি তিনি যে বিষয় বেছেছেন, তাও অনেক বিস্তৃত পরিসর দাবী করে। মনসামঙ্গলের আখ্যানভাগ নিয়ে হয়তো তাঁর একটা প্রাসাদ রচনার পরিকল্পনা, আমরা যেন তার একটি জানলা দিয়ে একটি মুহূর্তের জন্যে কুয়াশায় ঢাকা নদীপথে বেহুলার ভেলাটি দেখতে পেলাম। ভাষা নিয়ে তাঁর সচেতনতা আমাদের মুগ্ধ করল।
কেকা বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘আমিও’ সাম্পতিক তোলপাড় করা মি টু র ছায়া কেকার গল্পে। তার সঙ্গে তিনি সুচারুভাবে মিশিয়েছেন একটি অপ্রত্যাশিত মোচড়। শেষের টুইস্টটি একে একটি সার্থক অণুগল্প করে তুলেছে।
সোনালির ‘ঘাট’ একটি নিটোল অণুগল্প আমরা শুনলাম। মনে পড়ে যাচ্ছে প্রেমচাঁদের বিখ্যাত কাফন গল্পটি। মৃতের থেকে জীবিতের দাবী যে অনেক বেশি, তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এ গল্প।
ব্রততী সেন দাসের ‘ছোবল’ গল্পটি এক অভিনব সেলফ ডিফেন্সের কথা বলে। ধর্ষণ নিয়ে লেখা গল্পে সাধারণত যে চড়া মেলোড্রামা থাকে, তার বাইরে চমৎকার রিলিফ এনে দেয় এ গল্পটি।
 

শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৯

গল্প বৈঠক - কিছু কথা, কিছু ছবি এপিজে সাহিত্য উৎসব মঞ্চে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্য চর্চা নিয়ে আলোচনায়





শহরের আনাচেকানাচে এবং বাঁকুড়া, বীরভূম এবং হুগলী জেলার পর, রবীন্দ্র সরোবর থেকে বিভিন্ন ক্যাফে, মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে লেখকের বাড়ি, ছাদ বাগান থেকে একাডেমি অফ ফাইন আর্টস, শরতসমিতি থেকে এবার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। আজ গল্প বৈঠক এর ৩৫ তম অনুষ্ঠান। ধন্যবাদ এপিজে বাংলা সাহিত্য উৎসবের কর্ম কর্তা দের। আমরা টানটান গল্প লিখি ও পাঠ করি। সেটাই আমাদের পরিচয়।

চারবছর ধরে গল্প বৈঠক নিয়ে পথচলা, সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্য consumption & creation, গল্প লেখকদের সঙ্গে সংযোগ এবং নেট ওয়ার্ক তৈরী, কমেন্ট এবং ক্রিটিসিসম সয়েও survival of the fittest আমাদের গল্প বৈঠক। এখন একটা নিকট বন্ধুবৃত্ত বা circle of trust এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে গল্প বৈঠক। আজ তার স্বীকৃতি দিল এপিজে বাংলা সাহিত্য উৎসব।






বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯

গল্প বৈঠক -৩৪ @ স্কুলডাঙা, বাঁকুড়া

 গল্পবৈঠকের ৩৪ তম আসর বসেছিল বাঁকুড়ার স্কুলডাঙায়। আর্ষ পত্রিকার দফতরে। রবিবারের মধ্যাহ্নভোজের পর সুখঢেঁকুর তুলতে তুলতে দুপুর ঘুমের হাতছানিকে প্রশ্রয় না দিয়ে হাজির হয়েছিলেন স্থানীয় মানুষজন। সেদিন উপস্থিত ছিলেন মোট আটজন গল্পকার।  গল্পের আলোচনায় ছিলেন আর্ষ পত্রিকার সম্পাদক মধুসূদন দরিপা এবং গল্পবৈঠকের পক্ষ থেকে হাজির ছিলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে একসুতোয় পরিচালনা করেছিলেন বাঁকুড়ার লেখক ভজন দত্ত। সঞ্চালনায় ছিলেন শ্রাবন্তী বটব্যাল। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কবি উমা মাহাতো এবং প্রাবন্ধিক বিপ্লব বরাট প্রমুখরা। 

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় সদ্য প্রয়াত নবনীতা দেব সেন কে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন। তাঁর জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন এবং একটি সঙ্গীত পরিবেশনার পরেই শুরু হল সেদিনের গল্পপাঠ।  
সেদিনের প্রথম গল্পকার ছিলেন গল্পলোক পত্রিকার সম্পাদক এবং লেখক রামামৃত সিংহ মহাপাত্র।  তাঁর "দেবী" গল্পটির থিম বহুচর্চিত। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো মেয়েদের ভর হওয়া, ডাইনি বানিয়ে দেওয়া বা তা থেকে তার দেবীতে উত্তরণ নতুন কোনো ঘটনা নয় কিন্তু আঞ্চলিক ডায়ালেক্ট প্রয়োগে এবং লেখনশৈলীর মুন্সিয়ানায় অন্যরূপে যেন ধরা দিল গল্পটি।গল্পটি শুরুতেই মাত। "ভর করলে তুই মানুষ থাকুস নাই, দেবতা হয়ে যাস" সংসার পেতেও সুখ হয়নি পুতুলের। একে একে বাপী, বাদল সবার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ঘর ছেড়ে বাবার কাছে চলে এসেছিল সে।  তারপর কিভাবে যেন সবাই মিলে পুতুলের মধ্যে ভর হওয়া এবং তার থেকে রোজগারের একটা দিশা দেখতে পায়। মানে পুতুল কে ব্যাবহার করে গ্রামের লোক এবং সেই সঙ্গে তার বাড়ির লোক‌ও। যেন নিজে দেখেশুনে বিয়ে করে ঘর করতে পারোনি এবার কাজে লাগো একটু। সেইখানেই গল্পটি সার্থক।  
  
পরের গল্পকার রম্যলেখক পার্থসারথি গোস্বামী। গল্পের নাম "টার্গেট"। লেখক যে রম্যরচনাই লেখেন তা বেশ বোঝা যায়।  গল্পটি শুরু হয় ক্রিকেট ম্যাচ দিয়ে। এবার তার গতিময়তায় এবং গল্পের বুননে প্রতি ছত্রে ছত্রে হাসির খোরাক গল্পটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। আমাদের অতি পরিচিত ঘরগেরস্থালির কথোপকথন, শাশুড়ি বৌমার অভিযোগ, অনুযোগ এবং গৃহকর্তা বাড়ি ফেরার পরেই সেই চাপান‌উতোরের মধ্যে দিয়ে এগুতে থাকে গল্পটি।   এদিকে গৃহস্বামীর সেই বহু আশার ক্রিকেট ম্যাচটি যেন মনের দোরে কড়া নেড়েই চলে। তার মধ্যেই ছেলের পড়াতেও ভাটা। বেচারা গৃহকর্তা!  অথচ খামতি নেই তার ঘরণীর সিরিয়াল সর্বস্বতায় আর সেই সিরিয়াল থেকে গল্প বারেবারেই এসে বরের ক্রিকেট ম্যাচের ইন্টারেস্টিং মূহুর্তে রিলে করার তাড়না। খুব আটপৌরে টপিক কিন্তু আদ্যোপান্ত হাসির খোরাক গল্পটিতে।  

এরপরের গল্প বৈশাখী গুপ্ত"তেলের শিশি"। বেশ নতুন ধরণের গল্প। এক পরিবারের মায়ের মৃত্যু কে ঘিরে। মায়ের মরদেহ শ্মশানে দাহ করার মধ্য দিয়ে একটি অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিমায় কথোপকথন। সেই মৃত মানুষটিকে বারেবারে টেনে আনা প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে ডোমেদের সেই মড়া পোড়ানোয় কত টাকা রফা হবার মত অথবা মৃত গৃহকর্ত্রীর সংসারে ছেলের "ব‌উ" আনার ফলে তাঁর সংসারের মোড় ঘুরে যাওয়া অবধি  বিষয়গুলিও। সেই আলাপচারিতা যেন শুনতে পায় জ্বলন্ত চিতার মধ্যের মানুষটি। একদিকে দাউদাউ চিতার আগুণ অন্যদিকে রাস্তার টিমটিমে পথবাতির দপ করে জ্বলে ওঠা। সেই মূহুর্তেই মৃত মায়ের ছেলে আবিষ্কার করে পুরনো, চেনা "মা, মা" গন্ধটা।  তার মনের আলোড়নের ছবিটা নিটোল। প্রিয়জন আগুণে জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে যেতে যেতে মনের ভেতরের হাহাকার টের পায় সে।   মায়ের অস্থি ভাসিয়ে সে বুঝতে পারে মায়ের মর্ম। আবার তার পায়ে যখন টান ধরে,  তখন তার মায়ের বানিয়ে রেখে দেওয়া তেলটি‌ই সে ব্যাথার মোক্ষম ওষুধ, মালিশ করে দেওয়া হয় তার পায়ে। মা বেঁচে থাকতে সে তেলের মর্ম কেউ বোঝেনি আজ বুঝি সেই তেলের সার্থক প্রয়োগ হয়।  সেখানেই গল্পের নামকরণটি সার্থক।  

এরপর সংকল্প নামে একটি সাহিত্যপত্রের যুগ্ম সম্পাদক সাধনচন্দ্র সত্পথীর গল্প অস্তরাগ। এই গল্পে মধ্যজীবনের সংকটটি বেশ প্রকট ভাবে ধরা পড়ল। সুদেষ্ণার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া দিয়ে শুরু হয় গল্পটি। সেই থেকে এক চরম সেন্স অফ ইনসিকিউরিটি এবং এক‌ই সঙ্গে স্বামীর প্রতি তার অধিকারবোধ তুলে এনেছেন লেখক।  যথারীতি আগের রাতে তুমুল ঝগড়া হয়ে বাক্যালাপ বন্ধ সুদেষ্ণা পরদিন প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে সঙ্গিনীদের সঙ্গে হাসতে পারেনা, হাসাতেও পারেনা।  সুদেষ্ণার লেখক স্বামী  সুদেবের একনিষ্ঠ সাহিত্যচর্চার কারণেই সে ঝগড়ার সূত্রপাত। কেবলি স্ত্রী ভাবে সে একা হয়ে পড়ছে। তার প্রতি স্বামীর মনোযোগ নেই। মানে অ্যাটেনশন ডেফিসিয়েন্সি তে ভোগেন সুদেষ্ণা । আর সেই থেকেই জন্ম নেয় সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং নিরাপত্তাহীনতা। এই অবধি ঠিক ছিল সবশেষে সুদেষ্ণা কে খুশি করার জন্য, তার হাসিমুখ দেখার জন্য সুদেব যেকোনো মূল্যে তার  গল্প লেখার অভ্যাসটিকে প্রশ্রয় দেবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এই বিষয়টা নিয়ে লেখক আরো ভাবতে পারতেন।   

এরপর  সংকল্প সাহিত্যপত্রের আরেক যুগ্ম সম্পাদক  সবিতাব্রত সিংহবাবুর "একটি রঙিন ছাতার গল্প" বিষয়ে বৈচিত্র্য না থেকেও সার্থক ছোটগল্পে উন্নীত। 
অভাবের সংসার। অসুস্থ বাবা। সুবর্ণ টিউশান পড়িয়েও চেষ্টা করে চলে। ভাবে একদিন দুর্ঘটনায় পঙ্গু বাবা ভালো হয়ে যাবে ঠিক। বাবা যেমন নিজের পায়ে আর কোনোদিন দাঁড়াতে পারবেনা সেটাও যেমন ঠিক সুবর্ণ ও যে আবার পড়বে, চাকরী করবে সেই আশা নিয়ে বেঁচে থাকে মা। "দিশাহারা মানুষ স্বপ্নের মধ্যেই আবার দিশা খুঁজতে থাকে" সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাইন এটি। 
মায়ের অসহায়তা, তাঁর বড় ছেলের আলাদ সংসার পাতা সবেতেই ভারাক্রান্ত মন ভালো দেখিয়েছেন গল্পকার।  
আরও একটি বাক্য বেশ মনে রাখার মত। "সম্পর্কগুলো ঘূর্ণীয়মান চাকার মতো আজ যে উপরে আছে কাল সে নীচে নেমে যাবে"                
আবার সেই টানাপোড়েনে সুবর্ণর ছাত্রী নীলার সঙ্গে তার মধুর প্রেমের দিকটাও বেশ ভাল লাগে। তবে শেষের দিকটা বড় দুঃখের। সেখানে  নীলার সঙ্গে অধরা প্রেমের দিকটা আরও নিপুণ করে দেখানো যেত। সুবর্ণর জীবনে ছাতা গুলি আর রঙিন হয়ে ওঠেনা। 
প্রথম বর্ষের ছাত্র হামিরুদ্দিন মিদ্যার গল্প "মায়ের জান" সম্পূর্ণ বাস্তবধর্মী একটি গল্প। মুসলিম সমাজে এখনো যে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের দিনযাপন হয় তা বেশ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন হামির। মেয়েরা যুগ যুগ ধরে মেনে নিচ্ছেন বারেবারে গর্ভধারণের মত বিষয়টিকে। এরূপ এক মা বারবার গর্ভধারণ করে ক্ষান্ত হন না। বরং গর্ভে সন্তান না এলেই তিনি অসুখী। কোল খালি থাকাটা যেন সেই মায়ের পক্ষে নিন্দনীয় অপরাধ। তাঁর সংসার যাপনের অপরিহার্য অঙ্গ হল সন্তানের জন্ম দেওয়া।ছাগলছানাদের দেখেও তার মা হবার সাধ জাগে।এহেন মা'টি যখন জানতে পারলেন যে বর্তমানে গর্ভ ভাড়া দেওয়া হয় তখন তিনি সেই পন্থাতেও মা হতে ইচ্ছুক, জানালেন সেইকথা।  তবে হামির‌উদ্দিনের বাক্যগঠন আরো উন্নত হোক। এখন সে সাহিত্যজগতে নতুন। তার কাছে আরো প্রত্যাশা র‌ইল আমাদের।  
    
পরের গল্প অনুষ্ঠানের আয়োজক, টেক-টাচ-টক পোর্টালের অন্যতম কর্ণধার ভজন দত্তের। গল্পের নাম "কানাঘুঘু"। অত্যন্ত সময়োপচিত এবং প্রাসঙ্গিক গল্প আজকের যুগে দাঁড়িয়ে। 
এখনকার জীবনে সবকিছুই খুল্লামখুল্লা। অনমিত্রের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে উঠে আসে গল্প বলা। তার অফিস কলিগ আকাশ চরিত্রটি রয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে। মুখ বুজে কিছু বন্ধুত্ব সহ্য করে যেতেই হয় তেমনি অনেকটা। অনমিত্র আকাশকে বলে যাচ্ছে, পাখি শিকারের কথা।অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনে যেতে হচ্ছে আকাশকে। এভাবেই গল্পের শুরুয়াত। অফিসের পদমর্যাদা, স্ট্যেটাসের মত কিছু অনুষঙ্গ এসে পড়ে গল্পে যা সুন্দরভাবে ফুটিয়েছেন লেখক। আকাশ জানে অনমিত্রের স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে। 
অনমিত্র কিন্তু এক ছদ্ম গাম্ভীর্য নিয়ে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে থাকেন না। স্বীকার করেন একের পর এক তার নারী সঙ্গের কথা। আকাশ সব বোঝে কিন্তু বুদ্ধি করে চলে।ঘাঁটায় না। একের পর এক এভাবেই পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে পড়ে দুপক্ষ। এই বিস্তারিত বাক্যালাপের দিকটায় গল্পটির সুতো একটু হলেও ঝুলে গেছে বলে মনে হয়। 

"একি শুধুই লোভ! ভোগবাসনা! না কি কোথাও একটু ভালোবাসা!" এই বাক্যটিই যথেষ্ট ছিল সেখানে।  
এরপরেই মঞ্চে উড়ে আসে হাজির কানাঘুঘু। রমা নামের এক পাখীটিকে ধরার ফাঁদ পাতেন কণিকা নামে এক কনাঘুঘুর মাধ্যমে।   
আকাশ জানতে চায় কানাঘুঘুর অর্থ। কানাঘুঘু ব্যবহার করা হয় পাখি শিকারের বা ধরার জন্য। 
"শিকারিরা প্রথমে একটি পাখিকে পোষ মানায় প্রথমে, তারপর সেই পাখিটির চোখ কোনো কোনো শিকারি আবার অন্ধ করে দেয়।যেখানে পাখি ধরার ফাঁদ পাতে সেখানে পাখিটিকে পায়ে বেঁধে তার চারপাশে খাবার ছড়িয়ে দেয়। পাখিটা খায় আর ডাকে। তার ডাক শুনে অন্য পাখিরা এসে শিকারির ফাঁদে পড়ে।তারপর শিকারি ইচ্ছেমত পাখিগুলিকে জবাই করে।" এটি গল্পের উৎকৃষ্ট দিক। 
ওদিকে আকাশের স্ত্রী রীপাও যে অনমিত্রের ফাঁদে পা দিয়েছে এবং গল্পের শেষ মোচড় এটিই যেখানে আকাশের নিজেকে মনে হয় কানাঘুঘুর মত। গল্পটির মধ্যে উপন্যাসের বিন্যাস হলে আরও ভালো হবে। গল্পের প্লট হিসেবে সার্থক। 

লিখলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের  "ঘুমপাড়ানি চাউমিন" গল্পটির শ্রবণ প্রতিক্রিয়া জানালেন ভজন দত্ত

"মা যখন শীতের রাতে কাঠ জ্বালিয়ে রান্না করতেন, আমরা আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে দেখতাম মা ভাতের হাঁড়ি থেকে একটা হাতায় করে কয়েকটি ভাত তুলে টিপে টিপে দেখে বলতেন,'ব্যাস হয়ে গেছে।' 

গল্পবৈঠক ৩৪ এ আমাদের বাঁকুড়ায় এসে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের কাছে যখন 'ঘুমপাড়ানি চাউমিন' নামের গল্পটি যেই শুনলাম, তখন আমার মায়ের কথাই মনে হলো প্রথমে। ঠিক যেভাবে এই গল্পে মায়ের চাউমিন রান্নার গল্প বলছে টাপুর।ছোটরা কত নিঁখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা আমরা হয়তো কেউ খেয়াল করি না!গল্পচ্ছলে এই গল্প শুরু হলেও সমাজের এক ভয়ংকর বা বিভৎস রূপের পর্দা ছিঁড়ে এই গল্প যেন চোখে আঙুল দেওয়ার এক গল্প।কন্যাভ্রুন হত্যার কথা আমরা জানি অনেকেই। জানি, কন্যা সন্তান হলে এখনো তাদের নানাভাবে  মেরে ফেলার কথা।এই গল্পটি সেখান থেকে ১৮০° ঘুরে এক জীবনের কথা বলে এবং শেষ পর্যন্ত  ভালোবাসার কথা বলে।যে টাপুর জানে তার মা তাকে নর্দমা থেকে কুড়িয়ে এনে মানুষ করেছে,সেই যখন তার মায়ের কাছেই  জানতে চায় সত্যিটা, তখন টাপুরের মা সমাজের  যে নির্মম সত্যটি যেভাবে তুলে ধরেন তা পাঠককে, শ্রোতাকে স্তব্ধ করে এই গল্পের কাছে, গল্পের স্রষ্টার কাছে নত করে ভাবতে বাধ্য করে,সেখানেই গল্পকারের মুনশিয়ানা এই গল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
গল্পকার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের সমগ্র সৃষ্টিকে আমার জানার,পড়ার সৌভাগ্য হয়নি,সে আমার দুর্ভাগ্য। মায়ের ঐ ভাত দেখার মতোই বুঝতে পারছি, তাঁর সৃষ্টি, সৃজন কতখানি মর্মস্পর্শী হতে পারে। হাতে গোণা কয়েকটি শব্দের মধ্যে তাঁর যে খেলা, সেই খেলায় তিনি বিজয়ী এবং পাঠকও বিজয়ী। আমার সৌভাগ্য হলো দিদির মুখে দিদির লেখা একটি অসাধারণ গল্প শোনার।আরো শুনবো, পড়বো। ফুটন্ত ভাতের গন্ধেই এখন যে ভীষণ খিদে পাচ্ছে।