আষাঢ়ের তিন তারিখ হয়ে গেল, না কি চার? অথচ বৃষ্টির দেখা নেই। সমস্ত কলকাতা বাষ্পাকুল কেটলির মত ফুঁসছে শুধু। তারই মধ্যে ত্রিকোণ পার্কের মাড ক্যাফের মৃত্তিকা নামের একটা ঘরের চৌহদ্দিতে, অবশ্যই এসি-র বদান্যতা সহই, চমৎকার বসবার ব্যবস্থা এবং অ্যাকুস্টিকস নিয়ে, জমে উঠল চতুর্দশ গল্পবৈঠক অথবা গবৈ। মাঝামাঝি অথবা শেষের দিকে প্রধান আহবায়ক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বললেন, গবৈ কেন আলাদা। কেননা গবৈ কোন পত্রিকা বার করেনা, ফান্ড রেজিং করে না, গবৈ পুরস্কার ঘোষণাও করে না।সম্মাননা দেয় না কারোকে। এখানে নবীন প্রবীণ সদস্যরা আসেন গল্পকে ভালবেসে। গল্পের টানে। আর কোন স্বার্থ থাকেনা। এভাবেই পথ চলছে গবৈ, একের পর এক অনুষ্ঠানে ভেন্যু থেকে ভেন্যুতে জম্পেশ হয়ে উঠছে সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত আদান প্রদানে, অংশগ্রহণে, বন্ধুতায় ।
সেদিন অর্থাৎ ১৮ই জুন, ২০১৭ শুরু হল অধিবেশন ঠিক বিকেল চারটেতে। মাড কাফে-র তিনতলার মৃত্তিকা ঘরটিতে তখন দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্র সঙ্গীতের হালকা অনুরণন । লাল শানের মেঝে দেওয়া পুরনো বাড়িটিতে একদা থেকে গিয়েছেন জর্জ বিশ্বাস ও শম্ভু মিত্র , তৃপ্তি মিত্র, ভাড়াটিয়া হিসেবে। আজ সারাবাড়ির কোণে কোণে তাঁদের ছবি টাঙানো। প্রাথমিকভাবে গান দিয়ে শুভারম্ভ । বর্ষার গান গাইলেন ডাঃ সুতপা গুপ্ত।
তারপর গল্প পাঠের সূত্রপাত। প্রথমেই আষাঢ়ের দিনটার নিয়মরক্ষা করা হল একটি দুর্দান্ত ভূতের গল্পের আবহ দিয়ে। কৃষ্ণা দাসের সান্ধ্য সমাপতন। রীতিমত রোমাঞ্চকর এক কাহিনির সূত্রপাত। পটভূমি এক পুরাতন বাড়ি, তার ছাত। সে ছাত থেকে দেখা যায় কাঁসাই নদী। রোমহর্ষক গল্প। পরবর্তী গল্প নিবেদিতা ঘোষ মার্জিতের ভ্যাঁদা। নিবেদিতার বেশ কিছু গল্প শুনেছি আমরা আগের গবৈ তে। তার একটিও আমাদের হতাশ ত করেই নি, উল্টে প্রত্যাশা আরো বাড়িয়ে চলেছে। ভ্যাঁদা গল্পেও ছোট ছোট বাক্যে একটা স্পষ্ট সহজ ছবি পাওয়া গেল, সমাজমনস্ক মানবিক এক গল্পের রেণু লেগে ছিল এই ক্ষুদ্র লেখায়। চাইলে পরবর্তীকালে এ গল্পকে বিস্তারও দেওয়া যায়। এর পরের গল্প ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের “অ্যাক্রোফোবিয়া”। নামকরণেই একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া। খুব ভাল গল্পকারের বৈশিষ্ট্য লেখন ভঙ্গিমায়। অল্প কথায় ঘটনাক্রমের বর্ণনা এবং শেষমেশ উত্তরণ। দুটি অর্থে অ্যাক্রোফোবিয়া শব্দের ব্যঞ্জনাকে ছড়িয়ে দেওয়া। অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া। বিসমিল্লায় গলদ পড়লেন স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়। অ্যাক্রোফোবিয়া গল্প যেমন নাম নিয়ে খেলা করে। স্বপ্নার লেখায় নামটাই গল্পের বড় অংশ। গল্পে কোথাও সরাসরি নামটার সংযুক্তি না থেকেও, গোটা গল্প জুড়ে একটা গলদের ছায়াচ্ছন্নতা ঝেঁপে আসে। অতিবাস্তব কিন্তু অত্যন্ত সংযত সেই বিবরণ। জাম্প কাটে পরিণত। এর পর জয়তীর শেষ উপহার। বাস্তব ঘটনা অনুসরণে লিখিত। একটা দুর্দান্ত প্রেমের গল্পের প্রচন্ড ঝাঁকুনিময় পরিসমাপ্তি। স্তম্ভিত করে। সুলিখিত, সুপঠিত। মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়, ঘটনার বীভৎসতায়। রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্প এই ভারি হয়ে আসা পরিমন্ডলে একটা দারুণ রিলিফ, যেরকম তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েই থাকি। শব্দখেলায় দক্ষ আর রসবোধে অনুপম রজত, সকলের রজতদা রীতিমত নাকানি চোবানি খাইয়েছেন সেই সব স্বঘোষিত শিল্পবোদ্ধাদের যারা শিল্পকে “কিসসু হয়নি' বলে দাগান অথবা অন্য কারুকে ‘কিসসু বোঝেনি' বলে গালি দেন। কাঁদি কাঁদি কলা আর শিল্প কলার সম্পর্ক রজতদা স্পষ্ট বুঝিয়ে ছাড়েন।
নন্দিনী সেনগুপ্ত এর পর দেখালেন যাদু। তিনি ছিলেন এদিনের অতিথি গল্পকার। প্রথমদিনেই জার্মান গল্পের অনুবাদে “ বোলিং ট্র্যাক / ক্রীড়াভূমি” একটি অসামান্য অভিজ্ঞতা ছিল আজ। অনুবাদ বলে ত মনেই হয়না এত জোরালো বাংলা। ক্ষমতাশালী অনুবাদক নিঃসন্দেহে। আর পড়েছেন অবাক করা এক শ্রুতিনাটকীয় ভঙ্গিমায়। স্যালুট নন্দিনীকে, এই রকম চিরতরে সমকালীন এক বিষয়কে অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের কাছে এনে দেবার জন্য। যুদ্ধের গল্প প্রতিদিনের যুদ্ধদামামার সময়ে অত্যন্ত স্পর্শ করে যায় আমাদের। সুগত চৌধুরীর ক্যাবলা, বেশ চমৎকার একটি কলেজি প্রেমের গল্প। প্রেমের গল্পকে সূক্ষ্মভাবে রসবোধ দিয়ে ধরার ক্ষমতা খুব অল্প লেখকেরই থাকে। এখানে সুখ এবং দুঃখ দুই মিলে মিশে অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য ঘটে উঠেছে। চেনা চেনা মানুষের ছবির সঙ্গে মিলেমিশে যায়। কৃষ্ণা রায়ের মাতৃপর্ব। এক চমৎকার মনস্তাত্বিক কাহিনি। তিন প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধন। মা মেয়ের সম্পর্কের ভেতরে করুণা পর্ব ঈর্ষ্যা পর্ব। নানা পর্বের দোলায়মানতা। স্পর্শযোগ্য। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের পরী। ভিন্ন এক অবস্থান বা দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যে কোন ছোট গল্পই আমাদের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভব আনে। চেনা গল্প তখন অচেনা। গ্রামের মেয়ে পরীর দৃষ্টিকোণের সারল্য, তার বঞ্চনা এবং অ্যাবিউজের অনুভবটি ছুঁতে সাহায্য করে শ্রোতাকে। শাশ্বতী সরকারের অহল্যা নামে একটি গল্প এর পর। প্রেমবুভুক্ষু এক নারীর গল্প। যে নিজে পাথরই থেকে যায়। বার বার চেষ্টায় তার চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়। অথবা যে পুরুষ কে সে কামনা করে অন্য পুরুষের সম্পর্ক মিলেমিশে যায় তার মধ্যে। চৈতালি চট্টোপাধ্যায় এরপর পেশ করেন অপ্রস্তুত নামের অতি ক্ষুদ্র এক অণুগল্প। চমক এবং বিস্ময়ে যে কোন শ্রোতাকে ছুঁতে সক্ষম গল্পটি। একজন মানুষকে সামান্য জেনে তাকে ভুল বোঝার প্রবণতা কতটাই না আমাদের , সেদিকে আঙুল তোলে এ গল্প। এর পর কনিষ্ক ভট্টাচার্য পড়েন অদ্ভুত আঁধার এক নামে একটি বিস্ময়কর লেখা। গল্পটি আমাদের এই সময়কে এমনই এক তীক্ষ্ণ শ্লেষে তুলে ধরে যে কশাহত হয় শ্রোতা। সংখ্যা ছড়িয়ে পড়েছে ঝড়ের অভিঘাতে, সমুদ্রতীরে। এ দৃশ্য হিচকক বা পূর্ব ইউরোপের কোন চিত্রপরিচালকের ছবির সুররিয়াল দৃশ্যের মত আমাদের আচ্ছন্ন করে। সেই সংখ্যা তুলে তুলে শিক্ষক সৈন্য রাজনীতিক সাংবাদিক সকলেই তাঁদের কাজে লাগাতে থাকেন। শেষ যেখানে এসে বাঁক নেয় গল্পটি সেটা সমসাময়িক একটি ঘটনাকে তুলে আনে মনোদেশে। সুস্মেলী দত্ত পড়েন গ্রহণ নামে একটি গল্প। মনস্তাত্বিক গল্প এটিও। নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া এক মেয়ের কথা। গ্রহণ শব্দটির দুই প্রচলিত অর্থই মাথায় আসে। করুণা হয় মূল চরিত্রকে। এবার গার্গী রায়চৌধুরীর আলোর ডায়েরি। ডায়েরি ফর্মে লেখা এক মেয়ের লড়াইয়ের কাহিনি। লেখাপড়া করে নিজের প্রতিষ্ঠা পাবার পথে যে সব সাধারণীদের অনেক বাধা, তেমনই এক মেয়ের উত্তরণের কাহিনি এটা। আশাবাদী। এখানেও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই আলোর উৎস। শেষ গল্প যশোধরা রায়চৌধুরীর “ঐ বাড়িটা”, কিশোরপাঠ্য গল্প। এ গল্পের চরিত্ররা মনুষ্যেতর। শেষ পাতে খানিক হাসির আমেজ। অনুষ্ঠান শেষ হয় অনেক সুখাদ্য ( দার্জিলিং চা ও গ্রিলড স্যান্ডুইচ) সহকারে। একেবারে শেষে আবার গান।
যশোধরা রায়চৌধুরীর কলমে