বুধবার, ১১ মার্চ, ২০২০

গড়বেতায় গল্পবৈঠক ৪০

   

সাহিত্যিক অভিজিত্ চৌধুরীর উত্সাহে এবং আয়োজনে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা ৩ ব্লকের চন্দ্রকোণারোডের পরিমল কাননে  অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গল্পবৈঠকের চল্লিশতম অনুষ্ঠান।সেদিন ছিল আন্তর্জাতিক নারীদিবস কিন্তু গল্পপাঠে সংখ্যাগুরু ছিলেন জেলার পুরুষ গল্পকারেরা।প্রত্যেকে নিজের সেরা গল্পটি পরিমল কানন সভাগৃহে পাঠ করলেন । প্রত্যেকটি গল্পের সুচারু আলোচনা করলেন সহ লেখকরা নিজেদের মধ্যেই। সব গল্পকার এবং উপস্থিত সকল শ্রোতাদের জন্য সুন্দর মধ্যাহ্নভোজনের ব্যাবস্থাও ছিল সেদিন।  লীনা চৌধুরীর গান দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হল। প্রথম গল্প "চারুবালা" , পড়লেন জয়ন্তী মণ্ডল ।  খুব চেনা ঘটনা অবলম্বনে বর্তমানে বৃদ্ধদের করুণ জীবনের কাহিনী যখন গল্প হয়ে ওঠে তখন মনে হয় শেষের সেদিন কি ভয়ঙ্কর হতে পারে। আত্মীয় পরিজনেরা ত্যাগ করে তাদের। তবে এই গল্প সেই আত্মীয় পরিজনদের কথাটুকু সামান্যতম উল্লেখ দাবী করে।  শুধুমাত্র বৃদ্ধার প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক হয় পাঠক-শ্রোতার। বিপরীতে আত্মীয় পরিজনেরা কেন কাঠগড়ায় সেটাও জানতে ইচ্ছে হল। তবে গল্পের ঠাস বুনুনি আগাগোড়া ভালো লাগে। এরপর কাশীনাথ সাহার গল্প "টান"। মূলতঃ রম্য লেখক এত সিরিয়াস একটি গল্প শোনালেন যে শুনতে শুনতে মন চলে গেছিল প্রান্তিক জনজীবনের মানুষজনের দিকে। অতি সাধারণ বিষয়, অতি চর্চিত প্রেম, মেয়েদের শরীরের দিকে পুরুষের নজর,  আঞ্চলিক ভাষার বয়ানে অনবদ্য হয়ে ওঠে। গ্রাম্য মেয়ের অনুভূতির কথা কিম্বা তার স্বামীর হাবভাব, বিশেষতঃ মদনা চরিত্রটি অত্যন্ত মুনসিয়ানার সঙ্গে এঁকেছেন লেখক। তাঁর কলমকে কুর্ণিশ জানাই।
এরপর রবিঠাকুরের গান গাইলেন নির্মাল্য বিশ্বাস। অপূর্ব তাঁর গায়কী, বলাই বাহুল্য।
তিন নম্বর গল্পটি পড়লেন রাজীব কুমার ঘোষ। গল্পের নাম "প্রতিবিম্বের দিনগুলি" 
গল্পটি ইশকুল লেভেল পদার্থবিদ্যার সাধারণ জ্ঞান দিয়ে শুরু । আয়নার সম্মুখে প্রতিবিম্বের প্রকৃতি দিয়ে। সেটির উল্লেখ প্রয়োজন ছিল বলে আমার মনে হয়না। তবে তারপরেই শুরু হয় মূল গল্প। মনে করিয়ে দেয় জয়ন্ত নার্লিকারের গণেশের শুঁড় বাঁদিক থেকে ডান দিকে সরে যাবার বিখ্যাত গল্পের কথা। রাজীবের গল্পের বৈশিষ্ট্য তাঁর গল্প বলার সাদামাটা ভাষা। নির্মাণ অত্যন্ত ভালো। সেই গুণে অন্যমাত্রা পেল গল্পটি। আয়নায় আমাদের ডানহাত ভার্চ্যুয়ালি বাঁহাত। এই বিষয় দিয়ে এমন সুন্দর গল্প লিখলেন বলে সাধুবাদ জানাই তাঁকে।   
এরপরের গল্পকার সুমন মহান্তি। লব্ধপ্রতিষ্ঠ ইতিমধ্যেই তিনি। গল্পের নাম "গ্লানিগরল" 
অভিজিত চৌধুরী মাত করলেন তাঁর শেষ নিবেদন  "প্রেমতলা" গল্প টি পাঠ করে । সেদিন গল্পবৈঠকের পক্ষ থেকে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়  একমাত্র হাজির ছিলেন কলকাতা থেকে।  তাঁর গল্পের নাম ছিল "চুনীর আংটি ও থুরা"। 
সেদিন সঞ্চালনার দায়িত্ত্বে ছিলেন বাচিক শিল্পী অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের শেষে মৌসুমী ঘোষ পড়লেন তাঁর অণুগল্প এবং সেদিনের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন মেদিনীপুরের কবি গুরুপদ মুখোপাধ্যায়, বৈঠকের গল্পগুলি নিয়ে সুন্দর আলোচনার মাধ্যমে। গল্প পাঠের ফাঁকে ফাঁকে নারীদিবসের কবিতা পড়লেন নবীন কবিরা।
সবশেষে মেদিনীপুরের অন্যতম কবি গুরুপদ মুখোপাধ্যায় গল্প নিয়ে আলচনা করলেন। তাঁর মতে প্রতিটি গল্প সূক্ষ্ম সুতোয় গাঁথা। বর্তমানে গল্পের একটি নতুন ঘরানা তৈরী হয়েছে।রাজীব ঘোষের গল্পের কাঠামো নির্মাণ অত্যন্ত ভাল। গল্পের শেষে যে অদ্ভূত ঘাই দিয়েছেন বড়ো সিম্বলিক।গল্পটি  ট্রেইল ধর্মী। অনেকটাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছেন তিনি।
সুমন মহান্তির গল্পটিতে কোনো ভণিতা নেই। যা বলতে চেয়েছেন ডায়রেক্ট বলেছেন তিনি তাই এত সুন্দর এই গল্পের সূক্ষ্ম মনোস্তত্ত্ব। চরিত্রগুলি আছন্ন করে রাখে কিছুক্ষণ।
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের গল্পটি একদিকে অলৌকিক অন্যদিকে ম্যাজিক রিয়েলিজম নির্ভর। লাতিন আমেরিকার মার্কেজের কথা মনে করিয়ে দেয়। ম্যাজিক রিয়েলিটি খুব সুন্দরভাবে তুলে আনলেন তিনি।
অভিজিত চৌধুরীর "প্রেমতলা" গল্পটি মনে করিয়ে দেয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের কথা। বৈষ্ণব আখড়া, কীর্তণের পদের ব্যাবহার আরো ভালো লাগে শুনতে। লেখকের নারী চরিত্র সুহাসিনী একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ চরিত্র। আমাদের মনের মধ্যে কামনার যে দ্বন্দ্ব বারেবারে আমাদের তাড়িত করে চলে,আমাদের মধ্যে আমি ও তুমির প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব আমাদের রক্তাক্ত করে চলে সুহাসিনী সেখানে পরাজিত হয়। কবি চরিত্রের বসনের মত সেও বলে ওঠে যেন "বলতে পারো কবিয়াল, জীবন এত ছোট ক্যানে?" 

আনন্দবাজার পত্রিকা, পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগে ৯ই মার্চ ২০২০