সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭

পঞ্চদশ গল্প বৈঠকে ১৫ জনের গল্প পাঠ


ল্পবৈঠকের পঞ্চদশ আসর বসেছিল শেষ আষাঢ়ের এক মন কেমন করা বিকেলে, দক্ষিণ কলকাতার পাটুলি অঞ্চলে । না, কোন বাঁধাধরা সভা কক্ষে নয়, “নেশা’স কিচেন” নামে এক রম্য নিরিবিলি রেস্তোরায় আমন্ত্রিত হয়ে। শব্দসীমা বেঁধে রাখা অথচ টানটান সংবেদী গল্প পরিবেশনই সাধারণত এই বৈঠকের উদ্দেশ্য। সাথে অবশ্যই থাকে নির্ভেজাল আনন্দে ঘেরা মেধাবী আড্ডা। এবারের গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল সম্পর্ক। শুরুতেই স্তোত্রপাঠ করে শোনালেন কবি, স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ সাহিত্যজীবি জয়া চৌধুরি। নিমেষেই বাণিজ্যিক রেস্তোরাটি আমূল বদলে গিয়ে হয়ে উঠল এক পরিশীলিত সাহিত্য-সভা। আর তাতে বিশেষ মাত্রা সংযোজন করতে এগিয়ে এলেন গল্পকার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, উৎপল কুমার বসুর স্মরণযোগ্য বর্ষার কবিতা এবং জয় গোস্বামীর মুক্তগদ্য জলঝারি থেকে পাঠে বৈঠকটি আশ্চর্য, সপ্রাণ গতিতে সঞ্চালিত হতে লাগল। চোদ্দটি ছোট গল্প আর একটি ভীষণ মন ছোঁয়া শৈশব স্মৃতিকথার আবহে সময়ের দোলাচল সে ঘরে টের পাওয়া গেলনা। মেধায়, মননে, প্রতিভার বহু স্বরে সম্পর্ক নামক এক অমোঘ জীবনব্যাপী সঙ্গতা নিয়ে আমরা বুঁদ হয়ে শুনলাম গল্পগুলি। সম্পর্কের মাঝে সম্পর্কহীনতার গল্পও প্রবলতর দাবি নিয়ে এগিয়ে এল। আসলে অভাব না থাকলে স্বচ্ছলতা কে যে ঠিকঠাক চেনা যায়না। এদিনের গল্পের আলোচনায় ছিলেন সাহিত্যিক কাবেরী  রায় চৌধুরী।




আসরের প্রথম গল্পটি পড়লেন এদিনের অতিথি গল্পকার সুবীর বোস। 
গল্পের নাম অনন্ত কুয়াশা।মানুষের ব্যক্তিগত যাপন চিত্রে কত যে বিচিত্র বিষয় লগ্ন থাকে ! মানসিক মেদুরতা, রহস্য ভরা ঘটনা থেকে শুরু করে গভীর গোপন কত যুদ্ধ-- বলিষ্ঠ ভাষায় লেখক জানিয়ে দিলেন,স্বল্প পরিসরে গল্প কত তীক্ষ্ণ সূচীমুখ হয়ে উঠতে পারে। ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প বিষম এর পটভূমি বেশ সাম্প্রতিক এবং চিরকালীন। ধর্ম পরিচয় গোপন করা এক গৃহ পরিচারিকার অকপট সত্য ভাষণ, কি ভাবে যে সংশয়-দীর্ণ সভ্য তথা শিক্ষিত মানুষকে দ্বন্দ্ব ও অসহায়তার অতল গহ্বরে পৌঁছে দিতে পারে, সে কথা লেখক বড় যত্ন নিয়ে তুলে ধরেছেন।



কৃষ্ণা রায়ের গল্প পিতৃপ্রতিম এর বিষয়বস্তুতে তেমন চমক নেই, আছে সন্তানের জন্য চিরকালীন, সীমাহীন, অযৌক্তিক স্নেহের বেদনাঘন আবহ । স্বেচ্ছায় অকরুণ হয়ে এক সফল প্রতিষ্ঠিত পুত্র-সন্তান লোক সমক্ষে নিজের অসফল বাবাকে “বাপের বয়সী বিরক্তিকর মানুষ” বলে চিহ্ণিত করলেও কাঙাল পিতৃহৃদয় সেই টুকু সবীকৃতিকেই পরম প্রাপ্তি বলে আঁকড়ে ধরেন। আমাদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া দাবি করে মনোযোগ কখনো এক নাগাড়ে স্থায়ী হতে পারেনা। তাই প্রয়োজন হয় ক্ষণিক বিরতির। এই বৈঠকে গল্প দিয়েই ইন্দ্রিয়দের শাসন করা হয়।আর এ তো জানা কথা, যথেষ্ট ভারী বিষয়বস্তুও রচনার প্রসাদ গুণে স্নায়ুর চাপ নামিয়ে দেয়।


রজতশুভ্র বন্দোপাধ্যায়ের আঁতলামো ও মাতলামো শুনে শ্রোতা বন্ধুরা প্রাণ খুলে হাসলেন। দুই সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ বিষয়কে নির্বাচন করে রম্যতা, হাস্যরস, চমক, শ্লেষ, সমকালীন নাগরিক জীবন এর মিশেল দিয়ে কী স্বচ্ছন্দ গদ্য যে লেখা যায়, রজতশুভ্রের লেখা যারা পড়েছেন বা শুনেছেন, সে কথা তারা স্বীকার করতে বাধ্য। জয়া চৌধুরি বরাবরই গল্প অনুবাদের ক্ষেত্রে বিষয়-বস্তুটিকে প্রাধান্য দেন। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। বলিভিয়ার এক লেখকের স্প্যানিস ভাষার গল্পের অনুবাদ, বন্ধ দরজা শিরোনামের গল্পটির প্রতিটি পর্বে চমক পাঠক-শ্রোতাদের এক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হতে দেয় না। চূড়ান্ত পর্বে বাবা-মেয়ের এক বিচিত্র সম্পর্কের সামনে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হতেই হয়।

বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক গল্পে স্থায়ী দাম্পত্যের চেনা অন্বয় ও সমীকরণ অনায়াসে গল্পটিকে পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায় । নিজস্ব মানুষটির মধুমেহ রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর জেনে সদা সমালোচক ঝগরুটে স্ত্রী রসকলির উদ্বেগ উপভোগ করে হারাণ। স্ত্রীর কোমল , মমতাময় আচরণের পালাবদলের উৎসে যে রয়ে গেছে অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন মানুষের আমূল নির্ভরতা, তারই তাগিদে হয়তো বা দীর্ঘ দাম্পত্যে মধুর বাতাবরণ তৈরি হতে অসুবিধে হয়না। জীবনের এক ধূসর সত্য এ গল্পে সহজ ছন্দে উঠে এসেছে। টানটান মেদহীন গল্প উপহার দিয়েছেন পারমিতা মুন্সি তার অসম্পর্কের গল্পে। নব পরিণীতা অতীব সুন্দরী স্ত্রী যে আদতে অজস্র সম্পর্কে লগ্ন থাকা ছদ্মবেশী আই এস আই গুপ্তচর, সে কথা জেনেও প্রেমাকুল স্বামীর সংশয় যায়না। বিচার ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করে প্রতারক স্ত্রী আত্মঘাতী হলেও সবামী তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ গল্প কি সত্যিই অসম্পর্কের? নাকি সমাজ-মান্য সংলগ্নতাকে উপেক্ষা করে শাশ্বত জীবন-লগ্নতার দলিল?

সুগত চৌধুরির ছেঁড়া চিঠি এক বহু চেনা হৃদয় রেখার কাহিনী, বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা দুঃখিনী মায়ের লেখা চিঠি, মেরুদন্ড হীন পুত্র গৌতমকে তার জন্মদিনে। আপাত ভাবে চেনা ছকের গল্পের মধ্যেও হয়তো বা রয়ে গেছে আরেক যোগসূত্র। ভগবান বুদ্ধ ঘর –সংসার ছেড়ে পথে নেমেছিলেন জীবনের বিচিত্রতার সাধনায়। আর আধুনিক যুগে সংসার থেকে বিতাড়িত মায়েরা বৃদ্ধাশ্রমে বাস করে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু- ইত্যাদি নশ্বর জীবনের যাপন কথার অমোঘ বার্তাটি হৃদয়ঙ্গম করেন।এ বার্তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে । বেশ উপভোগ্য ও স্মরণযোগ্য গল্প। শাশ্বতী সরকারের অমরত্বের খোঁজে গল্পের পরতে পরতে সম্পর্কের জটিল বুনন এসেছে সহজ ভাষায় । জীবনে তেমন কিছু না হয়ে ওঠা ভিকি হতাশা থেকে মুক্তি খোঁজে অনর্গল স্বপ্নচারণে, তার অবচেতন মনলোক ধর্ষক বাবার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের উপায় খোঁজে, আকাঙ্খা করে মাতৃজাতির প্রার্থিত সম্মান । এভাবেই সে খুঁজে চলে জীবনের জ্যোতিঃলোকের পথ।

তমালি রায়ের মানুষ হিন্দু-মুসলমানের নিটোল সম্প্রীতির গল্প। এ ধরণের গল্প যত বেশি লেখা হবে, আমাদের জনমানস গোঁড়া ধর্মীয় বাতাবরণ থেকে মুক্ত হয়ে তত বেশি যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠবে।

ঋণী গল্পে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বেশ ঝরঝরে ভাষায় তুলে এনেছেন সম্পর্কের এক ভিন্নতর বাঁক । মানুষের ব্যক্তিগত যাপন চিত্রের কত শত খুঁটিনাটি অস্তিত্বের খোঁজ সব সময় রাখা যায় না, রাখলেও সংশয় থেকেই যায়। এ গল্প এক হারিয়ে যাওয়া জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) পিতা ও আরেক একক মায়ের ছেলের জীবন কথা। পিতা পুত্রের সম্পর্কে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা কিন্তু চিরকালীন মানবীয় আবেগের দাবি কিংবা অন্বয়টি কে অস্বীকার করতে পারেনা। গল্পের এই মর‍্যাল মনে করিয়ে দেয় সাহিত্যচর্চার মহত্তর লক্ষ্য আসলে অফুরান জীবন রসের নিবিষ্ট সাধনা এবং মানব-কল্যানের নব দিগন্ত ।

বাবা–মেয়ের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব-জটিলতা নিয়ে গার্গী রায়চৌধুরীর সম্পর্ক গল্পটি বস্তুত একটি সুদূরপ্রসারী গল্পের অভিমুখ। প্রার্থিত পরিণতির প্রত্যাশা থেকেই যায়। প্রান্তিক মানুষের জীবনে নির্বীজ-করণের মত বাস্তব অথচ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে গল্প খুব কম লেখা হয়েছে। কৃষ্ণা দাসের নির্বীজ গল্পটি সেই হিসেবে বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। শিক্ষিত, সুভদ্র নাগরিক যেখানে নিজের জৈবিক দৈন্যের বিষয়টি এড়িয়ে দাম্পত্য পর্ব টিকেই স্বীকৃতি দিতে অপারগ হয়, অন্ত্যেবাসী, শ্রমজীবি মানুষের চেতনা সেখানে স্বাভাবিক জীবন বোধে অনায়াসে অতিক্রম করে যায়। প্রচলিত সমাজমান্যতার ছক উপেক্ষা করে নিজের পুরুষত্বকে বাজি রাখতে তার দ্বিধাহীনতাকে তখন বাহবা না দিয়ে পারা যায়না।

 গল্প শুনতে শুনতে শ্রোতার আত্মশক্তি যে সপ্রাণ হয়ে ওঠে সোনালির শায়িত বুদ্ধ গল্পটি না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন হত। অসাধারণ কিছু শব্দ বিন্যাস দিয়ে ঘেরা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি উদ্বোধনের গল্পটি বহু কাল মনে থাকবে।

আসরের শেষ পর্বে মহাশ্বেতা রায় শোনালেন ফেলে আসা ছেলেবেলায়, মা ভাই, প্রতিবেশী , বন্ধুদের সান্নিধ্যে ঝুলন সাজানো দিনের স্মৃতি। সেই সব ভাল লাগার উৎসব আধুনিক নাগরিক জীবন থেকে নিছক অবহেলায় হারিয়ে গেছে।মহাশ্বেতা রায় তার অনুপম গদ্যে, প্রায় রূপকথার ভাষায় তুলে আনলেন সেই মহার্ঘ কিছু দিন। আর সেই হারিয়ে যাওয়া ঝুলন উৎসব পালনের আনন্দের রেশ আমরা সবাই সারা অস্তিত্বে মেখে নিলাম। পৌঁছে গেলাম আমাদের অগম্য শৈশবের সোপানে, মনে পড়ে গেল সেই সব দিনের অজস্র অনাবিল সম্পর্কের কথা।



পনেরো জন গদ্যকারের স্বরচিত গল্পপাঠে পঞ্চদশ গল্পবৈঠক নিটোল পূর্ণতা পেল আরো দু’জনের সান্নিধ্যে। নেশা’স কিচেনের পক্ষ থেকে সাহিত্যপ্রেমী দীপা চ্যাটার্জীর আন্তরিক আপ্যায়ন এবং সেদিনের আসরে পঠিত গল্প নিয়ে বিশেষ অতিথি সাহিত্যিক কাবেরী রায় চৌধুরির খোলামেলা, অন্তরঙ্গ আলোচনা ছিল দিনের বাড়তি প্রাপ্তি । শর্তহীন স্নিগ্ধতায় এই দুই নারী গল্প বৈঠকের প্রতিটি সদস্য ও বন্ধুদের মানবিক সম্পর্কে জড়িয়ে নিলেন। গল্পবৈঠকের যাত্রাপথ এগিয়ে চলবে আরো কয়েক শতক আসরের লক্ষ্যে ।


কৃষ্ণা রায়