শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৮

২০১৮ য় প্রথম গল্প বৈঠক

ত ২৪শে জানুয়ারি, ২০১৮ অনুষ্ঠিত হল গল্পবৈঠকের সপ্তদশতম সাহিত্য বাসর। আনন্দের চাঁদের হাট বসেছিল ইছাপুর মণ্ডল রাজবাড়িতে । ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বাড়িতে শীতের নরম দ্বিপ্রাহরিক রোদ্দুরে গা এলিয়ে নেমে এলো গল্পেরা, তার সাথে পরম সুখে মাথা নেড়ে তাল দিল গঙ্গাতীরের মৃদু বাতাস। যারা গল্পবৈঠকের সাথে জড়িত, সবাই জানেন যে এখানে যারা আসেন, গল্প এবং শুধুমাত্র গল্পের টানেই আসেন। অন্য কোনও বিশেষ আকর্ষণ যেমন পত্রিকায় গল্প ছেপে বের হওয়া বা বিশেষ কোনও পুরস্কার প্রদান, সম্মাননা প্রদান, বই প্রকাশ... এসব কোনও কিছুর সাথে গল্পবৈঠক বা গবৈ-এর কোনও সম্পর্ক নেই।

মধ্যাহ্নভোজনের পরে ঘরোয়া এই বৈঠক শুরু হল অতিথি গল্পকার শতদ্রু মজুমদারের গল্প ‘কবি ও কবিতা’ দিয়ে। কাব্যপাঠের এক আসরে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক কবির কবিতার খাতা হারিয়ে যাওয়াকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে গল্পের ঘটনাবলী। কবির সন্দেহ, মানসিক দোলাচল, কবিতার পাণ্ডুলিপি হারানোর কষ্ট এসব অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে যেন লেখক বর্তমান সময়ের কাব্যলক্ষ্মীর দৈন্যদশার কথাই ব্যক্ত করলেন কিছু ব্যঙ্গের মোড়কে।

দ্বিতীয় গল্পকার ছিলেন প্রদীপ গুপ্ত। গল্পের নাম ‘বসন্তপূর্ণিমার খোয়াব’। চাঁদ এবং এক পাগল বাউলকে কেন্দ্র করে নেমে এলো এক স্বপ্নালু আবেশ। লেখার কাব্যিক শৈলীর মধ্য দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো এসে যেন মুছে দিল বাস্তব এবং কাল্পনিক জগতের সীমারেখা। গল্পের শেষে চন্দ্রোদয় বয়ে নিয়ে আসে নতুন আশাবাদী ইঙ্গিত।

তৃতীয় গল্পে নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত বললেন একটি মেয়ের গল্প। আমোদিনী কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও, এই গল্পেও চাঁদ একটি উল্লেখযোগ্য পার্শ্বচরিত্র, কারণ গল্পের নাম ‘চন্দ্রবিদ্ধা’। সত্যিই কি চাঁদ আমোদিনীকে উন্মাদ করে দেয়? নাকি সংসারের চার দেয়াল থেকে পথে বেরিয়ে জন্ম হয় আরেকটি নতুন মেয়ের, যে দূর থেকে পরম আমোদে পর্যবেক্ষণ করে জগতসংসার। সাধুভাষায় লেখা এই গল্পের জোরালো বার্তা পাঠক এবং শ্রোতামণ্ডলীকে ভাবতে বাধ্য করে।

চতুর্থ গল্পকার ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক কণা বসু মিশ্র; পড়লেন হার-না-মানা চিরযুবক মানুষের গল্প ‘সৌম্যকান্তি’। তিনি কোনওভাবেই মেনে নিতে চাননা তার বয়স বাড়ছে। টুকরো টুকরো খুশি রীতিমত হিসেব করে কুড়িয়ে বাড়িয়ে, সাজিয়ে নিতে চান বেঁচে থাকার আনন্দ। সংসার আড়ালে হাসে, তাল রাখতে পারেনা তার অদম্য ইচ্ছের সাথে, কিন্তু তাতে সৌম্যকান্তির বয়ে গেলো। আকর্ষক নানা সংলাপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা গল্পের পরিণতি চরম মুহূর্তে পৌঁছায়, যখন সৌম্যকান্তি নিজের বুড়োটে প্রতিবিম্বকেও আয়নায় লাথি মেরে অস্বীকার করেন।


 পঞ্চম গল্প ‘পরবাস’এ কস্তূরী চট্টোপাধ্যায় বিবৃত করেন একটি মেয়ের কথা। শিশুকালে, কিশোরীবেলায় উদারমন মা’কে সংসারে এমনকি নিজের অধিকারটুকুও দাবী করে নিতে দেখেনি বন্যা। হয়তো তাই সে নিজেও কোনওকিছু আঁকড়ে ধরেনা সেভাবে, বরং অসুখী সংসার-জীবনের অজস্র না-পাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে কখনও না-যাওয়া, এক অগম্য প্রবাসের। সহজ ভঙ্গিমায় লেখা এই গল্প টেনে রাখে, শ্রোতারা একাকার হয়ে যায় বন্যার সাথে, আশায় জাগে মন, তার অনাগত প্রেমের জন্য।

পরবর্তী গল্পকার তমালী রায় তার ‘অন্তর্লীনা’ গল্পে শুনিয়েছেন এক নারী দেবদত্তার কথা, যার অন্তর্জগত হঠাৎ টলে যায় মনোরোগে। ছাত্রজীবনে প্রিয় বন্ধু গুঞ্জন ছিল লেখালেখি এবং সৃষ্টিকর্মের অনুপ্রেরণা। মৃত্যু তাকে কেড়ে নিলেও, সেই বন্ধুর দেওয়া নাম ‘ভ্রমর’ এর মধ্যে সুপ্ত নিজেরই অস্তিত্ব যেন অতীত থেকে ফিরে এসে তৈরি করে এক দ্বন্দ্ব। অবশেষে সেই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসার কথা সরল অথচ মনোগ্রাহী ভাষায় বলেন গল্পকার।

অনিন্দিতা মণ্ডল তার ‘পুতুল’ গল্পে সহজভাষায় ব্যক্ত করেন যাদুবাস্তব। গায়ক পার্থর সঙ্গে চিত্রকর/ভাস্কর যীশুর বন্ধুত্বকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে কিছু নারী দাঁড়িয়ে থাকে শিল্পসৃষ্টির মায়াজগতের সাথে বাস্তবের সীমানা জুড়ে। এদের অস্তিত্ব পার্থর কাছে ইন্দ্রিয়াতীত মনে হয়, চিনেও চিনতে পারেনা। সবাইকে যেন যীশু বশ করে পুতুল বানিয়ে রেখেছে বলে মনে হয় তার। একসময় সে নিজেও একাকার হয়ে যায় যীশুর সৃষ্টির সাথে।

কৃষ্ণা দাস তার ‘গোপনীয়’ গল্পে বলেন দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনের চড়াই-উতরাইয়ের মাঝে থাকা এক নারী আদিরার কথা। সংসারে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে নিতে আদিরা হয়তো নিজের ভালোবাসাটুকুও চিনতে পারেনা। প্রতিশোধের গোপন খেলা কি তার নিজের সাথেই? স্বামী অরিন্দমের মাথার নিচের বালিশ ঠিক করতে করতে নিজেকেই সে আশ্বাস দিতে চায়, ‘ভালোবাসি না, একটুও না।’ মায়া জাগিয়ে শেষ হয় এই গল্প।

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় তার ‘পূর্বপুরুষ’ গল্পে বলেন আধুনিক সমাজের এক পুরুষের কথা, যে সবার নেতা হয়ে উঠতে চায় যেন আদিম পশুর দলের গোষ্ঠীপতির মতো। আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা সত্ত্বেও মানুষ অতিক্রম করে উঠতে পারেনা জিনের মধ্যে গ্রথিত থাকা তার পূর্বপুরুষ শিম্পাঞ্জির প্রবৃত্তি। নেতা হবার জন্য সে এমনকি অন্য কাউকে খুন করে নিজের পথের কাঁটা পরিষ্কার করতে চায়। সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকা টেলিভিশান চ্যানেলের স্টোরি এবং গল্পের নায়কের মনের দোলাচল শ্রোতাদের বিশেষভাবে স্পর্শ করে।

এই গল্পবৈঠকে ভিন্ন স্বাদের অনুবাদ গল্প নিয়ে এলেন জয়া চৌধুরী। এলেনা পনিয়াতৌস্কার স্প্যানিশ গল্প ‘পরিচয়’ পাঠ করে শোনালেন। সুন্দর পঠনভঙ্গিমায় শ্রোতারা সবাই যেন গল্পের নায়কের সাথে চাষির ট্র্যাক্টরে চড়ে সঙ্গী হলেন পাহাড়ের পথে। উপত্যকা পেরিয়ে গল্প পৌঁছায় এক উত্তরণের দিকে, যখন গল্পের নায়কের কাছ থেকে কোনও দান সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে, চাষি নিজেই তাকে একটা নাম দিতে চায়। কারণ, যে তার অন্তরের সম্পদে ঋদ্ধ, শুধুমাত্র সেই পারে কিছু দিতে।

থিওডোর স্টর্মের লেখা একটি জার্মান শিশুগল্পের অনুবাদ ‘হাবুলের ভ্রমণবৃত্তান্ত’ পাঠ করেন নন্দিনী সেনগুপ্ত। বেশি বেশি ঘুরে বেড়াতে গিয়ে হাবুলের ভারি বিপদ হয়েছিল, কাজেই অতিরিক্ত কোন কিছুই যে ভালো নয়, এই গল্প সেরকম এক নীতিশিক্ষার কথা বলে। এছাড়াও দেখানেপনা করতে গিয়েই হাবুল নিজের বিপদ ডেকে এনেছিল, অতএব দেখানেপনার বিরুদ্ধেও একটা বার্তা আছে এই গল্পে।

মিষ্টিমুখ এবং খোলা আকাশের নিচে আড্ডা-গানে শেষ হল গল্পবৈঠক। অনতিদূরেই গঙ্গার বহমানতার সঙ্গে গল্পের প্রবাহ নিয়ে ঘরে ফিরলাম আমরা । এবারের আসরের পরম প্রাপ্তি ছিল কণা বসু মিশ্রের উপস্থিতি, যিনি অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে তাঁর লেখক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করে, আলো করে রেখেছিলেন গবৈ। নিঃশর্ত বন্ধুত্বে জড়িয়ে থাকা গল্পবৈঠকের মানুষেরা সূর্যের অস্তরাগে মিশিয়ে মেখে নিয়েছিল এক আনন্দের গুলাল। গবৈ এগিয়ে চলুক এভাবেই বন্ধুদের গল্পহাত জড়িয়ে। 



প্রতিবেদন লিখলেন নন্দিনী সেনগুপ্ত