মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭

গল্পবৈঠকের বিদেশ সফর- ৫ই মে ২০১৭


 মে মাস, ২০১৭। ফিলাডেলফিয়া পৌঁছানোর আগেই নিউজার্সির তিন লেখকবন্ধুকে কথা দেওয়া ছিল। 
ছেলের কাছে গিয়েই যেন তাদের সঙ্গে একটিবার হলেও দেখা করি। আর বন্ধু মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী তো আগাম নেমন্তন্ন করেই রেখেছিল তার বাড়িতে অন্ততঃ একটিবেলা যেন পাত পেড়ে খেয়ে আসি। ফেসবুকে তার রন্ধনশৈলীর দিব্যি পরিচয় পেয়ে আসছি সুস্বাদু বাহারী সব পদের মনোহরা ছবি দেখে।  তাতেই এদ্দিন গ্যাস্ট্রোনমিক ফূর্তি হত। মৈত্রেয়ী যে সু রাঁধিয়ে তা জানতাম। সে রাঁধে আবার গল্পও বাঁধে নিজের কলমে।  তার গল্প সংকলন বহ্নিশিখাও পড়ে ফেলে তাকে ফিডব্যাক দিয়েছি। তার গদ্য বেশ সরস। প্যাপিরাস ই-পত্রিকায় তার টের আগেই পেয়েছি। আরেকজন হল সুদীপ্তা বুয়া চ্যাটার্জী। সেও একসময় ব্লগ লিখত। প্যাপিরাসেও লিখেছে। মৈত্রেয়ীর পড়শী আরেক সৃষ্টিশীল মেয়ে। প্ল্যান ছিল অনেক কিন্তু ফিলি তে পা দেবার আগেই ফেসবুকে সুদীপ্তার ছেলের হাত ভেঙে যাবার ছবি দেখে সেখানে গিয়ে উতপাত করা বা গল্পবৈঠকে সামিল হওয়া, কোনোটাই মাথায় ছিল না। এই সুদীপ্তা আর মৈত্রেয়ী ফেসবুক আমাদের কলকাতার গল্পবৈঠকে ছবি দেখলেই এতদিন ধরে মনখারাপ করত আর বলত, দিদি, এখানে এলেই কিন্তু গল্পবৈঠক হবে। মনে আছে তো?



আরেকজন বন্ধু হল সংগ্রামী লাহিড়ী। তার সাথে আমার ওঠাবসা বহুদিনের। প্রথমে বেথুন, তারপর সায়েন্স কলেজ আর তারপর আমার কর্তার সহকর্মী ছিল সে প্রাইস ওয়াটার হাউস, কুপার্স, কলকাতায়। সংগ্রামী কোর বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্রী। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট অনুরাগ এবং দখল তার। ফেসবুকে তার আর আমার সাহিত্যচর্চা, নিয়মিত ইন্টারনেট আবাপ তে আমার লেখা পড়ে সে দেশ থেকে জানানো ইত্যাদির ফলে সংগ্রামীর সঙ্গে সে বিদেশবাসী হবার পর লেখালেখির কেমিষ্ট্রিটা জমে উঠছিল। প্যাপিরাসেও লিখেছে সে বার দুয়েক।  এবার ফিলি তে গিয়ে একটু থিতু হয়েই মনে হল, আশেপাশেই এই তিনবন্ধু কে অন্ততঃ জানিয়ে দি ব্যাপারটা, যে আমি এখানে এসেছি। নয়ত ফেসবুকে ছবি সাঁটালে ওদের মন ভার হবে। ওরা বলবে, খেলব না, সংগ্রামী, সুদীপ্তা, মৈত্রেয়ী তিনজনেই বেদম গোঁসা করবে। আরো যেসব বন্ধুরা আমেরিকায় আছে তারা আমার থেকে অনেক অনেক দূরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিন্তু এই তিনজন একদম পাশের স্টেটেই। ইনবক্স করতেই ফোনাফুনি আর তারপরেই চরম উত্তেজনা আমাদের চার বন্ধুর।



- দিদি, তোমরা willow grove স্টেশনে পৌঁছনর মিনিট দশেক আগে একটিবার কল করে দিও রাজর্ষিকে। আনন্দের চোটে সব ভুল হয়ে যাচ্ছে, আচ্ছা, তোমাদের আশাকরি কোনো ফুড অ্যালার্জি নেই, যদি থাকে একটু জানিও...

কি আনন্দ! কি আনন্দ! বিদেশ বিভূঁই তে বাঙালী বন্ধু যেন সহোদরা।

মৈত্রেয়ীই দায়িত্ব নিল। তার বাড়িতেই এক সপ্তাহান্তে গল্পবৈঠক হবে। সেই সঙ্গে ডিনার। 

আগেই বলেছি ফিলাডেলফিয়ার যোগাযোগ ব্যাবস্থার জন্মলগ্নে বৃহষ্পতি তুঙ্গে। বাস, ট্রাম (ট্রলি) এবং লোকাল ট্রেন পরিষেবা একটিমাত্র কোম্পানির অধীনে যার নাম সেপটা (SEPTA) বা সাউথ ইষ্টার্ণ পেনসিলভেনিয়া ট্রান্সপোর্টেশান অথোরিটি । আর তাই বুঝি এত সুসংবদ্ধ এই নেটওয়ার্ক ।  অতএব পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেলাম বেলাবেলি। টিকিট কাটাই ছিল অনলাইনে।  ঘন্টাদুয়েক চলার পর মৈত্রেয়ীর কথামত নেমে পড়ি উইলোগ্রোভ স্টেশনে।  সেখানেই প্ল্যাটফর্মে হাজির ছিলেন বন্ধুপতি রাজর্ষি দা। মুগ্ধ হতে হল আতিথেয়তায়। কত যত্ন করে বেচারি নিজের উইকএন্ড প্ল্যান বাতিল করে শুধু আমার জন্যে  ছুটে এলেন অফিস কাছারি সামলিয়ে।
প্রিন্সটন  মেডোজ এর  প্লেনসবরোতে কার্পেটের মত সবুজ ঘাসে মোড়া জঙ্গলের মধ্যে মৈত্রেয়ীর বাড়ি পৌঁছলাম। কিছপরেই রীতিমত মাঞ্জা দিয়ে মাটন কারীর ঝোলা হাতে সুদীপ্তার প্রবেশ সাউথ ব্রান্সউইক থেকে।আর তার কিছু পরেই পার্সিপেনি থেকে এল সংগ্রামী তার কগনিজেন্টের ব্যাস্ত দায়ভার সামলিয়ে, নিজে হাতে বেক করা কেক নিয়ে।    
তারপরেই চা কফি পর্ব সঙ্গে মৈত্রেয়ীর হাতের বানানো ফিশ পকোড়া, সংগ্রামীর কেক জমে গেল সেই বিকেলে। এবার কথা না বাড়িয়েই গল্প পর্ব। গল্পপাঠ শুরু হল। পাশেই জঙ্গল, পাখির কিচিরমিচির। বাইরে কাঁচের দরজায় ঝোলানো বার্ডফিড এর সুদৃশ্য  খুপরী।  হালকা ঠান্ডার রেশ তখনো। পাখী আসতে বাধ্য। মন উচাটন। ওরে ওরে রোদ থাকতে থাকতে ছবি তোল। ছেলে ছবি তুলছে কখনো পাখীর, কখনো আমাদের গল্পপাঠের।
অতঃপর, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে।
মৈত্রেয়ীর গল্পের নাম "চেরী রঙের ড্রেসার"। পুরোনো ড্রেসার কিনে গুপ্তধন লাভের গল্প, সত্যি ঘটনা অবলম্বনে... মুগ্ধ শ্রোতা, আমার পুত্র শুভায়ন, সুদীপ্তার দুই পুত্র, স্বয়ং শুভ্র আর সায়ন শুভ্র, মৈত্রেয়ীর কন্যা সুকন্যা এবংআমাদের তিনজনের পতিদেবতারা। আর কি চাই? একেবারে ফাঁকা মাঠে গল্প বৈঠক কখনো গোল দেয় না।



এরপর সংগ্রামীর সেদেশের ভারতীয় অভিবাসীদের নিয়ে, এক্কেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প। তারপরে সুদীপ্তার আগের দিন রাতে লেখা গল্প "নির্ভেজাল দিনের আত্মকথন"। আর  সবশেষে আমার অলৌকিক গল্প "চুনীর আংটি এবং থুরা" দিয়ে শেষ হল সেদিনের গল্পের আড্ডা । 

তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়া মৈত্রেয়ির ডাইনিং টেবিলে। রীতিমত সসৈন্যে আক্রমণ যেন। ডাল-ভাত-ফুলকপির ডালনার সঙ্গে ধোঁকার ডানলা, টার্কির বল কারি আর সুদীপ্তার মনোহরা মাটন জমে ক্ষীর সেই মূহুর্তে।

ছেড়ে যেতে মন চায় না তবুও ফিরতেই হল সে রাতে। রাজর্ষি দা আমাদের ছেড়ে দিয়ে গেলেন ফিলি তে। গল্পবৈঠকের টুপিতে আরো একটি পালক যুক্ত হল সেদিন। দেশের গন্ডী পেরিয়ে তার প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখা...বেশ অন্যরকম, খুব আনন্দদায়ক। এটি বিদেশে প্রথম আর সব মিলিয়ে ত্রয়োদশ বৈঠক ছিল।    

1 টি মন্তব্য:

  1. গল্প গুলো শুনতে পাইনি...আশা করি পড়তে পাবো।কিন্তু টার্কির বল.........।।কি মিস

    উত্তরমুছুন