সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৯

বসন্তে গল্পবৈঠক - মদনমোহন মন্দির, বেলঘরিয়া

সন্তে গল্পবৈঠকের আসর বসেছিল বেলঘরিয়ার মদনমোহন মন্দিরে। এটি ছিল গল্পবৈঠকের ২৭ তম আসর। প্যারীচাঁদ মিত্রর ঐতিহ্যমণ্ডিত ঠাকুরবাড়িতে মনোরম এক বসন্ত সন্ধ্যায় ১০ই মার্চ নবীনা ও প্রবীণা নজন লেখকের স্বরচিত গল্পপাঠ অনুষ্ঠিত হল। গল্পগুলির নির্দিষ্ট একটি সূত্র ছিল। সংস্কৃত নাটকে যে নয়টি রসের উল্লেখ আছে, নটি গল্প সেই নবরসের উপর আধারিত। সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর সঞ্চালনার বিশেষ দিকটি হচ্ছে তিনি অপূর্ব সুকণ্ঠের অধিকারিনী। গল্পের মাঝে মাঝে তিনি রবীন্দ্রগান পরিবেশন করে অদ্ভুত আবহের সৃষ্টি করেছেন। গল্পবৈঠকের কর্ণধার এবং অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান সার্থক হওয়ার পেছনে তাঁর সুচারু ভুমিকা নজরে পড়ে।
ওপর থেকে - অনিন্দিতা মণ্ডল, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, বুবুন চট্টোপাধ্যায় , সুবর্ণা রায়, নন্দিনী সেনগুপ্ত, আইভি চট্টোপাধ্যায়, পৃথা কুণ্ডু, ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণা রায় 

     শ্রীকল্যাণ নামের গল্পটি ছিল লেখক আইভি চট্টোপাধ্যায়ের । শান্ত রসের গল্প এটি। উত্তাল এবং বিধ্বংসী সম্পর্কের শেষে অভিষেকের অদ্ভুত এক উপলব্ধির জগতে প্রবেশ। পার্থিব মায়ার জগত ছেড়ে এক শান্ত নিস্তরঙ্গ মহাসমুদ্রে প্রবেশ করেছে তার মন। গল্পের শেষে মন আপনিই শান্ত হয়ে যায়। 
সুবর্ণা রায় পরিবেশন করলেন গোলাপি ক্ষত। রৌদ্র রসের গল্প। রাগের বহিঃপ্রকাশ নয়। স্বপ্নে ইচ্ছেপুরণের গল্প এক অত্যাচারিত মেয়ের। রোজ যে স্বামীর হাতে মার খায়। 
পৃথা কুণ্ডুর গল্প অজ্ঞাতবাস। বীররসের গল্প। এ গল্প শুনলে আমাদের চিত্রাঙ্গদাকে মনে পড়তে বাধ্য। 
ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় , গায়ক, সঞ্চালক, পরিকল্পক  

ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় গানও গেয়েছেন চিত্রাঙ্গদা থেকেই। এই গল্পের অধিকারী মহাশয় ও বিপ্লবী পার্থকে মনে থাকবে বহুদিন। নন্দিনী সেনগুপ্ত লিখেছেন বীভৎস রসের গল্প, সীমান্ত ক্ষত। দূর বিদেশে দুটি মানুষের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে সীমান্তের কাঁটাতার। যেখানে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ককে দুষিত করে তোলে যুদ্ধ ও ঘৃণার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। 
নিবেদিতা ঘোষ মার্জিতের গল্প উদ্ভট। অদ্ভুত রসের গল্প। সাহিত্যের অঙ্গনে প্রতিভাবান অথচ নবীনদের হেনস্থার একটি অপূর্ব শ্লেষাত্মক রচনা লিখেছেন নিবেদিতা। কিন্তু ক্রমশ চেপ্টে যাওয়া মানুষও যে ইচ্ছেপূরণের জন্য নিজের ভাবনা অনুযায়ী পাল্টে যেতে পারে তার প্রমাণ অন্তু। শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছেতে সে হয়ে যায় একটা ট্রাক, যার পিঠে হলুদ আলোর টুনি। লেখা আছে দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মতো ফুলবি। সত্যিই অন্তু চরিত্রটির  বন্ধু সাহিত্যিকদের বিদ্বেষের উত্তরে। তার ট্রাক হয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছু ছিলনা ! কৃষ্ণা রায় লিখেছেন নিশি স্পর্শ। ভয়ানক রস। এ গল্পটি শুনে শিউরে উঠতে হয়। সম্পত্তির জন্য বাবাকে চাপ দিতে থাকা, অসুস্থতাকে বাড়িয়ে দেওয়া, এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে কোমায় আচ্ছন্ন বাবার শরীর থেকে মাপ মতন মাংস তুলে আনা, এক লহমায় আমাদের নরখাদক বানিয়ে দেয়। সত্যিই ভয়ানক। বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘মৃত্যু’। করুণ রসের গল্প। আত্মজার আত্মহনন। এক আপাত নির্লিপ্ত পিতার মেট্রোয় আরেকটি সুইসাইড শুনে প্রথমে বিরক্তি, ‘কেন যে এরা মেট্রোকেই বেছে নেয়?’ থেকে শেষে অশ্লীল খসখসে গলার ফোনে জানতে পারা, মৃত্যু হয়েছে মেয়ের। বন্ধুদের সঙ্গে পাবে যাওয়ার অনুমতি না পেয়ে অভিমানে সে সুইসাইড করেছে। সত্যিই করুণ! কি অদ্ভুত অন্তঃসারশূন্য সমাজ তৈরি করেছি আমরা! 
গল্পটি অবশ্য আকস্মিক পাওয়া সংবাদে পিতার স্তব্ধ হয়ে যাবার কথা বলে। 

শৃঙ্গার রসের গল্প লিখেছেন অনিন্দিতা মণ্ডল। তাঁর গল্পের নাম হিয়ার মাঝে। এক যৌবন অতিক্রান্ত অধাপিকার প্রথম প্রেমের খোঁজে ছুটে বেড়ানোর গল্প। ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় এ গল্পের রেশে গেয়েছেন ‘আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্কভাগী’। মন ভেসে যায় সে গানে। 
হাস্য রসের গল্পে পটু ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। তাঁর গল্পের নাম ফেসবুকেন সংস্থিতা।এই ভার্চুয়াল জগত নিয়ে কি অপরিসীম আগ্রহ আমাদের! জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ফেসবুকের আড়ালে কল্পিত এক দেবীর পুজো নিয়ে গল্পের অন্তর্বর্তী শ্লেষ ধরা পড়ে। 
গায়িকা ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় এ গল্পের অনুষঙ্গে গেয়েছেন সুউপযুক্ত গান ‘ও ভাই কানাই’। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে বিদ্যাপতির ‘মাধব বহুত মিনতি করি তোয়’ পদটি দিয়ে। এ পদের সুর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মদনমোহন মন্দিরে এমন নিবেদনের পদ গেয়ে ইন্দিরা উপস্থিত সকলকে আবিষ্ট করেছেন। এভাবেই এই পর্বের বসন্তের গল্পবৈঠক রূপে রসে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল।          
     
প্রতিবেদন লিখলেন অনিন্দিতা মণ্ডল 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন